আব্দুস সাত্তার,টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: জীবন যুদ্ধে হার মানেনি জেলার দেলদুয়ার উপজেলার মঙ্গলহোড় গ্রামে অন্ধ প্রতিবন্ধী মাসুদ রানা।সে সমাজের বোঝা নাহয়ে তার দাদা হামিদ মিয়ার ১৩ শতাংশ জমির ওপর ২০১১ সালে এক হাজার মুরগি নিয়ে তৈরি করে লেয়ার মুরগি খামার।তার পর থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি প্রতিবন্ধী মাসুদ রানার। এখন তার খামাওে রয়েছে ২৩শ লেয়ার মুরগি ।প্রতি মাসে উপার্জন করে দেড় লক্ষাধিক টাকা। জিয়াউর রহমান (২৫) নামের এক জন কর্মচারীও রয়েছে মাসুদের।থাকা খাওয়াসহ তাকে প্রতি মাসে বেতন দিতে হয় ৭হাজার টাকা।
জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া এক জন মানুষ অন্ধ প্রতিবন্ধী মাসুদ রানা।মাসুদকে অন্ধত্বের চিকিৎসা করাতে এক সময় আর্থিকভাকে পথে বসেছিল তার বাবা মা । এখন সেই প্রতিবন্ধীই পুরো সংসারের হাল ধরেছে।সমাজ প্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করলেও, মাসুদের সাফল্য প্রমান করেছে “প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, উপার্জন অক্ষম ব্যক্তিই সমাজের বোঝা। স্ত্রী,সন্তান, ভাই-বোন, বাবা মাকে নিয়ে ভালই চলছে মাসুদের জীবন।
জানাগেছে,দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের মঙ্গলহোড় গ্রামে সামাদ মিয়ার চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মাসুদ রানা (৩৩)। বাবা মায়ের আদর কি তা বোঝার আগেই তিন বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে মাসুদের দু-চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে সেই সময়ে স্থানীয় চিকিৎসকসহ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা কওে পাঁচ লক্ষাধিক টাকা খরচ করেও ফেরাতে পারেনি চোখের আলো। তার পর থেকেই স্থায়ী অন্ধ হয়ে যায় মাসুদ রানা।অন্ধ বলে থেমে থাকেনি মাসুদ।
১১৯৩ সালে ১১ বছর বয়সে তিনি টাঙ্গাইল জেলা শহরে বিবেকানন্দ স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। লুইবেন হেলেন ক্লারের ব্রেইলি পদ্ধতিতে ১১৯৯ সালে পঞ্চম শ্রেণী পাশ করে বাড়ি ফিরে আসার পর নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করে। পরে ওই বছরই বাড়ির পাশে মঙ্গলহোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মুদি দোকান দেন। বেচা-কেনা ও টাকা নিতে কোন সমস্যায় পড়েনি তিনি। ২০০১ সালের শেষের দিকে গাজীপুরের টুঙ্গি প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বাঁস বেতের কাজ শিখতে যায় মাসুদ। সেখানেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি। কিছুদিন কাজ শেখার পর বাড়ি এসে পূণরায় কর্ম জীবনে আটকে যায়। এরপর থেকে জমা-জমির চাষ থেকে শুরু করে গরু পালন পর্যন্ত বাবাকে সব কাজে সাহায্য করতে থাকে। বাবা দুর্বল হওয়ায় কলের লাঙল ট্রাকটর স্ট্রাট করে দিত মাসুদ। দু-জনের উপার্জনে ছোট তিন ভাই বোন রাসেল,সোহেল ও সালমাকে পড়া লেখা শেষ করায়।
২০০৫ সালে তিনি নাটরের বরাইগ্রামে রেখা আক্তারকে বিয়ে করেন। মাসুদের স্ত্রী রেখা আক্তার বলেন, তাদের দাম্পত্য জীবন চলছে স্বাভাবিক। চলাফেরা এমনকি উপার্জনের দিক দিয়েও তার স্বামী অন্যদের মতোই। নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে অতি সহজে। তার ঘরে জন্ম হয়েছে অর্পা নামের এক কণ্যা সন্তানের। তাকে এবং মেয়ে অর্পাকে ভালবাসার নেই কোন কমতি। অর্পার বয়স এখন ৯ বছর। মঙ্গলহোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে অর্পা। অর্পা জানালেন, অর্পার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বাবা। স্কুলে যাওয়া থেকে টিফিন খাওয়ানো পর্যন্ত সব কাজে বাবা তাকে সহযোগীতা করে। কোন অভাবই তাকে লাগতে দেননি তার বাবা।
প্রতিবন্ধী হিসেবে দাদা হামিদ মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া ১৩ শতাংশ জমির ওপর ২০১১ সালে হাজার খানেক মুরগি নিয়ে তৈরি করে লেয়ার মুরগি খামার। মাসুদের খামারে এখন প্রায় ২৩শ লেয়ার মুরগি রয়েছে। প্রথম দু বছর নিজেই সব কাজ করতেন। বর্তমানে তার খামারে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছে নীলফামারী জেলার জিয়াউর রহমান (২৫) নামের এক যুবক। থাকা খাওয়ার পর তাকে ৭হাজার টাকা মাসিক মাইনে দিতে হয় ।
জিয়া বলেন, মাসুদ ভাই সব কাজই করতে পারেন। খামার বড় হওয়ার কারণে কর্মচারী লাগছে। স্থানীয় বাজারের ডিমের চাহিদা পূরণ করছে মাসুদের খামার। প্রথম পর্যায়ে বার্ডফ্লু রোগে মুরগি মারা যাওয়ায় খামারের লোকসান হলেও বর্তমানে তার মাসিক উপার্জন প্রায় দেড় লাখ টাকা। খামারে মুরগির খাবার দেয়া, পানি দেয়া, ডিম সংগ্রহ থেকে ডিম বিক্রি করা পর্যন্ত সব কাজই মাসুদ নিজে করছে। ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টানা কাজ করেও তার আত্মতৃপ্তি সে নিজে উপার্জন করছে। ছোট ভাই সোহেল ও রাসেলের টাকায় প্রথমে খামারটি তৈরি হলেও সংসারে এখন তাদের টাকার প্রয়োজন হয় না। তার উপার্জনেই সংসার চলছে। এমনকি তার ভগ্নিপতি ( সালমার স্বামী) মো. সেলিম মিয়া গত চার বছর আগে হৃদরোগে মার যাওয়ার পর থেকে সালমার সংসার খরচ বাবত মাসে ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে।
শুধু তাই না, প্রতিবেশী বহুলোক মাসুদের কাছে অর্থ ধার নিয়ে চলছে। কারো কাছে ধার না পেলে মাসুদের কাছে পাওয়া যাবে এ আস্থা স্থানীয়দের মাঝে। মাসুদের স্বপ্ন এখন দুটি। মেয়ে অর্পাকে সুশিক্ষিত করা। আর খামারটিকে আরো বড় করা।মাসুদের বাবা সামাদ মিয়া বলেন, মাসুদকে কখনই তারা প্রতিবন্ধী মনে করে না। সন্তান হিসেবে মাসুদ অন্য তিন ছেলে মেয়ের মতোই। জীবন যাপনও করছে স্বাভাবিক। সে সংসারের বোঝা না। এক সময় মাসুদকে সারিয়ে তুলতে তারা অনেকটাই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এখন মাসুদই সংসারের হাল ধরেছে। মাসুদের মা মাসুমা বেগম বলেন, যদিও শিশু বয়সে মাসুদ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু টাইফয়েডের পর থেকে মাসুরে দুটি চোখই স্থায়ী অন্ধ হয়ে যায়। মায়ের কাছ থেকে যতটুকু আদর হ পাওয়া দরকার, পরবর্তী তিন সন্তান জন্ম হওয়ায় ততোটা সময় দিতে পারিনি। তবে ওর জন্য দোয়া রয়েছে।
পাথরাইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওই গ্রামের আব্দুল আজিজ চান খা বলেন, মাসুদ একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করছে। চলাফেরা বা কাজকর্মে তাকে কখনই প্রতিবন্ধী মনে হয় না। বরং মাসুদ স্বাভাবিক মানুষের জন্য একটি মডেল। যা অনুস্মরণ করে একজন স্বাভাবিক মানুষ নির্ধিদায় সাবলম্বী হতে পারে। প্রতিবন্ধী মানুষ অনেক সময় সমাজ ও পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু মাসুদ তার পরিবার ও সমাজের জন্য সম্পদে পরিনত হয়েছে।
দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি মাসুদের পরামর্শ, প্রতিবন্ধী মনে করে পিছিয়ে না পড়ে কর্মমূখী শিক্ষা গ্রহণ করে শ্রম ও মেধা খাটিয়ে নিজেকে সমাজের বোঝা থেকে সম্পদে পরিনত করা সম্ভব। স্বাভাবিক মানুষের প্রতি তার অনুরোধ প্রতিবন্ধীদের অবজ্ঞার চোখে না দেখে তাদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া উচিত। সরকারের প্রতি তার চাওয়া, শুধু প্রতিবন্ধী দিবস না। সবসময় প্রতিবন্ধীদের পাশে থেকে তাদের শিক্ষা,কর্ম ও বাঁচার মতো পরিবেশ সুষ্টি করলে সমাজের কাছে এরা বোঝা থাকবেনা। পাশাপাশি সরকারের অর্থনৈতিক সহযোগীতার মাধ্যমে তাদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করলে সব প্রতিবন্ধীই সাবলম্বী হয়ে উঠবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম