কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে সুন্দরবন । বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশের সুন্দরবনেই ভূখণ্ড কমছে আর জলাভূমি বাড়ছে। সেই সঙ্গে সুন্দরবনে সুন্দরীসহ সব ধরনের গাছের সংখ্যাও কমছে। বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সুন্দরবনের ভূমি ও উদ্ভিদের পরিবর্তনের ধরন নিয়ে করা দুটি গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সিইজিআইএসের ‘সুন্দরবন জয়েন্ট ল্যান্ডস্কেপ ন্যারেটিভ-২০১৬’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২৪০ বছরে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার কমেছে। ১৭৭৬ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছিল ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। ২০১৬ সালে তা কমে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটারে নেমে এসেছে। গত ২৭ বছরে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৭৬ বর্গকিলোমিটার কমেছে, আর জলাভূমি অংশে আয়তন বেড়েছে ৩০ বর্গকিলোমিটার। মূলত সুন্দরবনে নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙনের কারণে আয়তন কমেছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সিইজিআইএসের সুন্দরবন-বিষয়ক গবেষণার প্রধান ও ডেপুটি নির্বাহী পরিচালক মালিক ফিদা এ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনের মানচিত্র, স্যাটেলাইট ইমেজ এবং সরেজমিনে অনুসন্ধানের মাধ্যমে গবেষণাটি করেছি। সুন্দরবনের জন্য হুমকিগুলো আমরা চিহ্নিত করেছি, যাতে তা রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবদুল আজিজ এবং বন বিভাগের বণ্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন সংরক্ষক অসিত রঞ্জন পাল যৌথ গবেষণা ‘বাংলাদেশ সুন্দরবন: পরিবেশ ও জৈব সম্পদের বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক আরেকটি গবেষণা করেছেন।
এতে দেখা গেছে, সুন্দরবনে ১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে ২৯৬টি গাছ ছিল। গাছের সংখ্যা নিয়মিতভাবে কমে ১৯৮৩ সালে হেক্টরপ্রতি গাছের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৮০-তে। ১৯৯৬ সালে তা আরও কমে হয় ১৪৪। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে গাছের সংখ্যা নেমে আসবে হেক্টরপ্রতি ১০৯টিতে।
১৯৫৯ সালে প্রতি হেক্টরে সুন্দরবনের প্রধান গাছ সুন্দরীর সংখ্যা ছিল ২১১। কিন্তু তা ১৯৮৩ সালে ১২৫ ও ১৯৯৬ সালে ১০৬-তে নেমে আসে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০২০ সালে হেক্টরপ্রতি সুন্দরীগাছের সংখ্যা নেমে আসবে ৮০-তে।
অবশ্য এই দুই গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে বন বিভাগ। গবেষণা দুটির ফলাফল তুলে ধরে সংস্থাটির মতামত জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী প্রথম আলোকে বলেছেন, সুন্দরবনের আয়তন তো কমেনি, বরং বেড়েছে। সেখানে গাছের সংখ্যা বাড়ছে। তাই এসব গবেষণার সঙ্গে তাঁরা একমত নন।
সিইজিআইএসের গবেষণায় ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের আয়তন ৫ হাজার ১২৪ বর্গকিলোমিটার কমেছে বলে উল্লেখ করে বলা হয়, গত ২৭ বছরে ভারতীয় অংশে ভূমির আয়তন কমেছে ৬২ বর্গকিলোমিটার এবং জলাভূমির আয়তন ৫৮ কিলোমিটার বেড়েছে।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের আয়তন যা বলা হয়, বাস্তবে তার চেয়ে কম। বর্তমানে বাংলাদেশ সুন্দরবন অংশের মোট আয়তন ৫ হাজার ৩২০ বর্গকিলোমিটার। আর ভারতীয় অংশের আয়তন ৩ হাজার ৯৪ বর্গকিলোমিটার।
তবে বাংলাদেশ ও ভারত—দুই দেশের সরকারি নথি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাবে সুন্দরবনের আয়তন বলা হয় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ বাংলাদেশ অংশে ছয় হাজার ও ভারতীয় অংশের আয়তন চার হাজার বর্গকিলোমিটার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের মানচিত্রের বদল নিয়ে করা আমার গবেষণায়ও আয়তন কমে যাওয়ার চিত্র দেখতে পেয়েছি। বিশেষ করে সুন্দরবনের যেসব অংশে মানুষের বসতি বেশি ও গাছ কম, সেখানে বেশি করে ভাঙন হচ্ছে।’ ১৯১৭ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে ৪২০ বর্গকিলোমিটার ভূমি কমেছে বলে জানান তিনি।
সিইজিআইএসের গবেষণায় দেখা গেছে, ১৭৭৬ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছিল ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ সালে হিসাব করে দেখা গেছে, তা কমে হয়েছে ৫ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। সুন্দরবন ঘিরে নানা ধরনের বাঁধ, পোল্ডারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে সুন্দরবনের আয়তন কমে আসছে। একই অবস্থা ভারতীয় সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও। ১৭৭৬ সালে ভারতীয় অংশে সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৮ হাজার ৭৩৩ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ সালের হিসাবে তা কমে ৩ হাজার ৫২ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে।
উদ্ভিদ নিয়ে করা গবেষণায় বলা হয়, সুন্দরবনে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার জন্য লবণাক্ততা দায়ী। এতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবন প্রতি সেকেন্ডে শূন্য থেকে ১৭০ ঘনমিটার পলিযুক্ত মিঠা পানি গ্রহণ করেছে। সেখানে লবণাক্ততার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য কমপক্ষে ১৯৪ দশমিক ৪ ঘনমিটার পানিপ্রবাহ প্রয়োজন। কম পানিপ্রবাহ থাকায় সাগরের লবণাক্ত পানি বনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। যদিও ১ শতাংশের বেশি লবণাক্ততা থাকলে সুন্দরীগাছের বেঁচে থাকা কঠিন।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, গঙ্গা নদীর মিঠা পানি গড়াই হয়ে পশুর নদ ও শিবসা নদীর মাধ্যমে সুন্দরবনে প্রবাহিত হয়। ফারাক্কা বাঁধের পর পানিপ্রবাহ কমে গেছে। ফলে মিঠা পানির প্রবাহ কম থাকায় লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ছে বনের মধ্যে। এ কারণে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারছে না। এর সঙ্গে সাইক্লোন ও বিভিন্ন কারণে বনভূমি ভেঙে ছোট ছোট নদী তৈরি হয়েছে।
জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত সার্বিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুন্দরবনের প্রতিবেশগত ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরী গাছ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বনের বিভিন্ন অংশে অনেকদিন ধরেই ভাঙন লক্ষ করা যাচ্ছে। সুন্দরবন রক্ষা করতে চাইলে সবগুলো ঝুঁকি আমলে নিয়ে কাজ করতে হবে।’
ভারতের অংশে আয়তন কমার চিত্র
১৭৭৬ সালে ছিল ৮,৮৩৩ বর্গ কিমি
১৮৪১ সালে ছিল ৮,৪৬৬ বর্গ কিমি
২০১৫ সালে ৩,০৫২ বর্গ কিমি
বাংলাদেশ অংশে আয়তন কমার চিত্র
১৭৭৬ সালে ছিল ১১,২৫৬ বর্গ কিমি
১৮৪১ সালে ছিল ৯,২৭৯ বর্গ কিমি
২০১৫ সালে ৫,৪৬৭ বর্গ কিমি
ভারত
৩,০৫২
বর্গ কিমি
বাংলাদেশ
৫,৪৬৭
বর্গ কিমি
কমছে সুন্দরীগাছ
১৯৫৯ সালে হেক্টরপ্রতি
সুন্দরীগাছ ছিল ২১১টি। কমতে কমতে ২০২০ সালে তা ৮০-তে নেমে আসার আশঙ্কা
কৃপ্র/ এম ইসলাম