কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ পাটের নামে একটি মন্ত্রণালয় আছে, কিন্তু তাদের হাতে নেই পাটের উৎপাদন, উন্নয়ন গবেষণা, কারিগরি গবেষণাসহ পাটের বাজার ও অর্থনৈতিক গবেষণার কোনো কিছুই। এসব দেখভাল করে কৃষি মন্ত্রণালয়। ফলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের পাট বিভাগের কাজ হচ্ছে শুধু বাজার থেকে উৎপাদিত পাট বা পাটজাত পণ্য কেনা এবং দেশে-বিদেশে তা বাজারজাত করা। এতে ঝুঁকিতে পড়ছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পাটের বাজার। ব্যাহত হচ্ছে দেশে-বিদেশে পাটশিল্প ও পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণের কাজ। খবর বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইনের।
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাট খাত। এ তথ্য সরকারি নথির। পাট আইন-২০১৬ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে সংসদীয় কমিটির সামনে আসে পাট খাতের এ দুর্দশার চিত্র। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সংসদীয় কমিটির কাছে পাটের উৎপাদন, উন্নয়ন গবেষণা, কারিগরি গবেষণাসহ পাটের বাজার ও অর্থনৈতিক গবেষণার পুরো বিষয়টি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে ন্যস্ত করার দাবি ওঠে। কমিটিও এতে সহমত পোষণ করে।
কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা কৃষি মন্ত্রণালয়। কারণ অন্যান্য ফসলের মতো পাটও একটি কৃষি ফসল হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় পাটের চাষ থেকে বাজার পর্যন্ত পুরো বিষয়টি শুরু থেকেই তাদের অধীন। ফলে এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ে শুরু হয়েছে টানাটানি। সর্বশেষ কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সভাপতিকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় এনে এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার বিষয়ে সংসদীয় কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়।
আইনগতভাবে পাটের বাজার উন্নয়ন, পাটশিল্পের সম্প্রসারণ, পাটপণ্য বহুমুখীকরণ, পাট ও পাটপণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির দায়িত্ব বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের। পাটের গুরুত্ব বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭৩ সালে পৃথক পাট মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফায়ও পাটের কথা বলেছেন। কিন্তু ১৯৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের একমাত্র জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন।
আর এই প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে পাটের ফলন ও উৎপাদন সংক্রান্ত কৃষি গবেষণা উইং, কারিগরি গবেষণা উইং, বাজার ও অর্থনৈতিক গবেষণা উইং। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয় পাটশিল্প, পাটপণ্য ও পাটের বিপণন করে না। ফলে পাটের কারিগরি গবেষণা উইং, বাজার ও অর্থনৈতিক গবেষণা উইং এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখাতে পারছে না বলে মনে করছেন অনেক সংসদ সদস্য। এ ছাড়া পাট, ধান বা গমের মতো কোনো সাধারণ ফসল ও পণ্যও নয়। বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর পাট উৎপাদনকারী দেশ। এখনো বিশ্ব বাজারে চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ কাঁচা পাটের জোগান দেয় বাংলাদেশ। তবে যথাযথ গবেষণা ও পরিকল্পনার অভাব এবং দুই মন্ত্রণালয়ের টানাটানিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত পণ্যের ৬০ ভাগ বাজার এখন বাংলাদেশের হাতছাড়া। এ কারণেই বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় চাইছে দেশের একমাত্র পাট গবেষণা কেন্দ্রটি আইন করে তাদের নিয়ন্ত্রণে দেওয়া হোক। এদিকে আইনগতভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাটসহ সব প্রকার ফসল উৎপাদন, গবেষণা ও সম্প্রসারণ।
এ জন্য ধান গবেষণা, কৃষি গবেষণাসহ এ জতীয় সব গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের অধীন। কৃষি ফলনের ১২০-১২৫টি ফসল নিয়ে কাজ করে এ মন্ত্রণালয়। মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের কাছে সব ফসলের কার্যক্রম সম্প্রসারণ, তদারকি, সমন্বয় ও উন্নয়ন। এক্ষেত্রে তাদের সাফল্যও আছে। কিন্তু তাদের পক্ষে পাটকে আলাদাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ফলে পাট দিন দিন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপিত নথি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বের এক নম্বর পাট উৎপাদনকারী দেশ হলেও বাংলাদেশের হাতে আছে মাত্র ১০ ভাগ পাট বীজ।
বাকি ৯০ ভাগ পাটের বীজ আমদানি করতে হয় ভারত থেকে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন পাট গবেষণা কেন্দ্র উচ্চ ফলনশীল পাট বীজ উদ্ভাবন ও কিছু পাটজাত পণ্যের গবেষণায় সাফল্য দেখালেও পাট বীজ শূন্য হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া যথাযথ তদারকির অভাবে পাটশিল্প ও পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে বিশেষায়িত কোনো ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাট খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাট আইন-২০১৬ পর্যালোচনা করতে গিয়ে সংসদীয় কমিটির সামনে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, পাট গবেষণা ও বীজ উৎপাদন একটি বড় সংকট।
বিশ্বের সবচেয়ে ভালো গুণগত মানসম্পন্ন পাট বাংলাদেশে উৎপাদন হয় বলে আমরা দাবি করি। কিন্তু এ পাট উৎপাদনের জন্য মাত্র ১০ ভাগ রয়েছে দেশি বীজ। ৯০ ভাগ বীজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়। আমাদের পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে যা কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত। তিনি মনে করেন, আইন করে এ পাট গবেষণা কেন্দ্র বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। একই সঙ্গে সুবর্ণচরের খালি জায়গায় পাট গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে বীজ উৎপাদনের কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়। এ সম্পর্কে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ১৯৬২ সালের অধ্যাদেশ বা পাট আইন দিয়ে চলছিল বাংলাদেশের পাট।
কিন্তু সে আইনটি ছিল মূলত ব্যবসাভিত্তিক ও লাইসেন্সনির্ভর। কিন্তু পাটের পুরো বিষয়টা পূর্ণতা দিতে হলে তার সামগ্রিক প্রতিফলন আইনে থাকতে হবে। যাতে পাট আইন একটি আম্ব্রেলা বা মাদার বিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এ জন্য পাট গবেষণার বিষয়টি পাট মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসার যৌক্তিকতা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। সংসদীয় কমিটি উপস্থাপিত সরকারি নথি থেকে জানা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা ৮০ ভাগ আসত পাট থেকে। এখনো বিশ্ব বাজারে চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগ কাঁচা পাটের জোগান দেয় বাংলাদেশ। এখনো জিডিপির ৩.৮৬ ভাগ জোগান দেয় পাট। এ খাতে প্রতি বছর ৮ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের পাটজাত পণ্যের চাহিদার মাত্র ৪০ থেকে ৫০ ভাগ জোগান দিতে পারছে বাংলাদেশ। এ জন্য বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট আমদানিকারক দেশগুলোর সঙ্গেই। অথচ পাটজাত পণ্যই একমাত্র শতভাগ দেশীয় কাঁচামালে উৎপাদিত পণ্য।
এ জন্য সরকার পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম কমিটিকে জানান, ১৯৬২ সালে যখন পাট অধ্যাদেশ করা হয় তখন পাটের কার্যক্রম ছিল পাট বেইল করা ও রপ্তানি করার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখন এক টন পাটের সুতা রপ্তানি করে ১ হাজার ডলার আয় করা যায়।
অথচ এক টন পাটের বহুমুখী পণ্য রপ্তানি করে ১০ হাজার ডলার আয় করা সম্ভব। এখন পাট থেকে বহুমুখী পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। পাটখড়ি থেকে চারকোল হচ্ছে। পাট পাতা থেকে চা হচ্ছে। পাটের শিকড় থেকে ওষুধ হচ্ছে। পাট থেকে কাপড় তৈরি হচ্ছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন করে পাট আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে বিলটি সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। আমরা আইনটিকে পূর্ণাঙ্গ একটি আইনে পরিণত করতে চাচ্ছি। যেখানে পাট চাষ, পাট উৎপাদন, গবেষণা, গুণগত মানোন্নয়নসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম