কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদকে কেন্দ্র করে এ অবস্থার সৃষ্টি হয় বলে জানা যায় । পানিসম্পদ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরের আলোচনায় তিস্তা চুক্তি সইয়ের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এমন এক পরিস্থিতিতে ‘তিস্তা চুক্তি খুব দ্রুত সই হতে হবে এমন নয়’ বলা হলে বাংলাদেশের দাবির যৌক্তিকতা কমে যায়। থবর প্রথম আলোর অনলাইনের ।
সম্প্রতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ভারতের সরকারি বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের খবরে বলা হয়েছে, তিস্তা চুক্তি খুব দ্রুত সই হতে হবে, এমন নয়। কারণ চুক্তিটিতে ‘জোরালো সারবস্তু’ থাকার চেয়ে এটি অনেক বেশি প্রতীকী হয়ে উঠেছে।
এ ব্যাপারে পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে যেটা বলা হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের অবস্থান নয়। তিস্তা আমাদের অগ্রাধিকারের বিষয়। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সই করার আশ্বাস দিয়েছেন। এ নিয়ে চুক্তির একটি খসড়ার বিষয়ে দুই দেশ রাজি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত অভ্যন্তরীণভাবে তাদের কিছু সমস্যার কথাও আমাদের জানিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের দেওয়া আশ্বাসে আমরা পুরোপুরি আস্থা রাখতে চাই।’
গত ২৯ আগস্ট পিটিআই ‘তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি এখন আর জরুরি বিষয় নয়: বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে। পরে ওই খবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রে যোগাযোগ করে জানা গেছে, পিটিআই তিস্তা নিয়ে খবরটি যখন প্রচার করে, তখন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান ভারতের রাজধানীতে ছিলেন। তিনি ২৫ আগস্ট দিল্লিতে যান। পরে কলকাতা ঘুরে ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ফেরেন। দিল্লি সফরের সময় তিস্তা নিয়ে পিটিআইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল কি না জানতে তাঁর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় । তবে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
পিটিআইয়ের খবরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, ‘এক অর্থে তিস্তা মশার কামড়ের মতো। আপনি বুঝতে পারছেন সেখানে মশা আছে, তবে তা আপনার অনেক রক্ত শুষে নিতে পারে না। বাংলাদেশে আবাদের মৌসুম বদলে গেছে। সম্পূরক সেচের পরিকল্পনা থেকে তিস্তা (চুক্তি) করা হয়েছে।’
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাংলাদেশের জন্য আর অগ্রাধিকার বিষয় নয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অগ্রাধিকার নয়, এটি আমি বলতে পারি না। ভারতের রাজ্য ও কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমীকরণের মধ্যে আমরা না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখন থেকেই আমি বলছি, ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়েছে সম্পূরক সেচের জন্য। কিন্তু আমাদের এখন অন্য সময়ে পানি দরকার। এটা এখনই ক্ষতিকর নয় যে আগামীকালই এর সমাধান প্রয়োজন।’
প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসায় তিস্তা চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করেও সেটি সই করতে পারেনি বাংলাদেশ ও ভারত। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে মমতার ঢাকায় আসার কথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা না করে চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে এই অভিযোগ এনে তিনি শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আসেননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের জুনে ঢাকা সফরের সময় অবিলম্বে তিস্তা চুক্তি সইয়ের আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ২০১১ সালে চুক্তির যেই খসড়া দুই দেশ চূড়ান্ত করেছে, সেটি অনুযায়ী চুক্তিটি হবে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে তিস্তার পানি এতটাই কমেছে যে তা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে করে দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষিকাজসহ মানুষের জীবিকা মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছে।
যৌথ নদী কমিশনের (বাংলাদেশ) উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডালিয়া পয়েন্টে যে পানি পাওয়া গেছে, তা ১৯৭৩-৮৫ সময়কালের গড় পানিপ্রবাহের চেয়ে অনেক কম। ডালিয়া পয়েন্টে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন, দ্বিতীয় ১০ দিন ও শেষ ১০ দিনে পানির গড় প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৭০১০, ৬০১০ ও ৫৬৬৮ কিউসেক। আর এ বছরের জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন, দ্বিতীয় ১০ দিন ও শেষ ১০ দিনে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ২৩৮৪, ১৭৬০ ও ১১৯০ কিউসেক।
পশ্চিমবঙ্গে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ শুরুর আগে ১৯৭৩-৮৫ সময়কালে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানির প্রবাহ বেশ ভালো ছিল বলে তুলনার জন্য ওই সময়কালের হিসাব উল্লেখ করা হয়।
৩৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর মধ্যে ভারতে প্রবাহিত ২৪৯ কিলোমিটার ও বাংলাদেশে ১১৭ কিলোমিটার। তিস্তার আওতায় মোট সেচ এলাকার পরিমাণ ১৯ দশমিক ৬৩ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৪৯ লাখ হেক্টর ও ভারতে ১২ দশমিক ১৪ লাখ হেক্টর।
নীলফামারী জেলার বৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতায় নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ দিতে প্রতিদিন ন্যূনতম ৩৫০০ কিউসেক পানির প্রয়োজন হয়।
কৃপ্র/ কে আহমেদ/ এম ইসলাম