কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ছবির পাখি দুটি কোড়া। ভরা বর্ষায় ভরা যৌবন নিয়ে এরা প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। পোষা মোরগের মতো লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। প্রজনন মৌসুমে একটি পুরুষ কোড়া অন্য পুরুষকে দুচোখে দেখতে পারে না। প্রতিটি পুরুষই তার রাজ্যসীমানা নির্ধারণ করে নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দেয়। গলা ফাটিয়ে ডেকে ডেকে সে মাঝেমধ্যেই নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়।
ছবির কোড়া দুটির বাঁ দিকেরটা বসে আছে, ডান দিকেরটা দাঁড়ানো। তিন মিনিটের লড়াইয়েই সে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দিয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বী আত্মসমর্পণ করেছে। বিজয়ী কোড়া মেয়ে কোড়াকে নিয়ে দিন কাটাবে। বাসা হবে, ডিম হবে, ছানা হবে।
ভরা বর্ষায় ধানখেত-পাটখেত-হোগলাবনসহ হাওর-বাঁওড়ের বুকে কোড়ার গান বা ডাক শোনা যায়। এদের লড়াইটা চোখ চেয়ে দেখার মতো। লড়াইয়ের পূর্ব মুহূর্তে এরা ঠিক পোষা দেশি মোরগের মতো মুখোমুখি হয়, চোখে রাখে চোখ।
প্রতিদ্বন্দ্বীর অসতর্ক মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠোঁট চালায়, পা দিয়ে লাথি কষে, বর্মে বর্ম ঠেকিয়ে দুটিতে পাঁঠা-ছাগলের মতো ঠেলাঠেলি যেমন করে, তেমনি একটু পিছিয়ে এসে ছাগলের কায়দাতেই একটু লাফিয়ে উঠে পরস্পরের শক্ত বর্মে আঘাত করে। সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো প্রতিপক্ষের পায়ের ৪টি লম্বা নখর নিজের নখরে কষে আঁকড়ে ধরা। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে যেকোনো মানুষ দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলতে পারবে দুটিকেই।
পোষা কোড়া দিয়ে বুনো কোড়া শিকার একসময় গ্রামবাংলার কৃষকদের কাছে ছিল শৌখিন শিকার। পোষা কোড়া ছেড়ে দিয়ে ও অন্যান্য কৌশলে পোষা কোড়া দিয়েই বুনো কোড়া শিকার করা হতো। এখন আবাসভূমি অনেক সংকুচিত হয়েছে, নিরাপদে ডিম-ছানা তোলা দায়। সারা দেশেই চিংড়ি অথবা সাদা মাছের খামার। জলভরা ধান-পাটখেত উধাও। ওরা তাই বেদিশাই বলা যায়। ১৯৭০ সালে বৃহত্তর খুলনায় যে পরিমাণ কোড়া ছিল, ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ ভাগে।
এই পাখিদের আরেক নাম জলমোরগ। বাগেরহাটে পুরুষটি কোড়া, মেয়েটি কুড়ি, ছানারা কুড়কুড়ি বা গুড়গুড়ি নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম Water Cock. বৈজ্ঞানিক নাম gallicrex chinerea. পুরুষটির মাপ ৪৩ সেমি, মেয়েটির ৩৬ সেমি। ওজন গড়ে ১৭০-১৯৫ গ্রাম।
এমনিতে মেয়ে-পুরুষের রং একই রকম। পিঠের উপরিভাগ ঘন-বাদামি, বুক-পেট-গলা-ঘাড় বাফ্ রঙা। গলা-বুক-পেট ও শরীরের দুপাশজুড়ে অসংখ্য আড়াআড়ি দর্শনীয় কালো কালো সরু টান। বর্ম হলুদাভ। তবে বর্ষা ঋতুতে শরীরে যৌবন ভর করলে পুরুষটির রং খুবই কালো হয়।
মূল খাবার এদের নানা ধরনের জলজ পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, জলজ ঘাসের বীজ-ধান-কাউন-চিনাদানা-কচিপাতা, শিকড়সহ ছোট শামুক। এরা ধানখেত-পাটখেতের পাখি। বর্ষা ঋতুর পাখি। বর্ষাকালেই এরা জলভরা খেত-সাম্রাজ্যের মহারাজা। শ্রাবণ-ভাদ্রে এদের প্রচণ্ড ডাকাডাকিতে মুখরিত হয় চরাচর। বাসা করে খেতের আইলের ওপর। বাসা থেকে নামার সময় মেয়ে পাখিটি প্রতিবারই ঘাস বা ধান পাতা দিয়ে বাসার ডিম ঢেকে রেখে যায়।
ডিম পাড়ে ৩-৬টি, ৭-৯টিও হয়। ৪টির সংখ্যাই বেশি। মেয়েটি একাই তা দেয় ডিমে। ডিম ফোটে ২০-২৪ দিনে। মুরগির তায়েও ফোটে ডিম। সময় ওই ২০-২৪ দিনই। ছানারা বাসা থেকে নেমে যখন মায়ের পেছনে পেছনে হাঁটে তখন অদ্ভুত সুন্দর দেখায়।
সুত্রঃ প্রথম আলো/ কৃপ্র/ এম ইসলাম