‘পানি খাতের সুরক্ষা ছাড়া এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখা যাবে না’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে বাংলাদেশের। নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা অববাহিকার পানি। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই অঞ্চলের দেশগুলোর পানিসম্পদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে জাতীয় পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে তুলনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এতে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে মাটির ওপরের ও নিচের—দুই ধরনের পানিরই অবস্থা খারাপ। মাটির নিচের পানি উত্তোলনের ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতাও বাংলাদেশে অনেক বেশি। প্রতিবেদনে জাতীয় পানি নিরাপত্তা ইনডেক্সে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলো হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপদেশ কিরিবাতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলোর ৮০ শতাংশ পয়োবর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই পানিতে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে নদীগুলোতে রাসায়নিক পদার্থের দূষণ বাড়ছে। নদীর স্বাস্থ্য দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছে। নদীর স্বাস্থ্যের অবনতির দিক থেকে শীর্ষে গঙ্গা অববাহিকার দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল।
ভূগর্ভের পানির অতিব্যবহার
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিবছর ভূগর্ভ থেকে ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার (কিউবিক কিলোমিটার) পানি উত্তোলন করে। এর ৮৬ শতাংশই ব্যবহৃত হয় কৃষির সেচকাজে। বাকি ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে ও ১ শতাংশ পানি শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। ভূগর্ভের পানি অতিব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ভূগর্ভের পানি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ভারত। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ইরানের অবস্থান। ভূগর্ভ থেকে অতিমাত্রায় পানি উত্তোলনকে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করছে এডিবি।
তবে এডিবির প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ভূগর্ভ থেকে মোট উত্তোলিত পানির যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের পরিবেশবিষয়ক পরামর্শক ইফতেখারুল আলম। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রায় ১৬ লাখ বিদ্যুচ্চালিত সেচযন্ত্র ও ৩০ হাজার গভীর নলকূপের মাধ্যমে বছরে ৪৮ থেকে ৫২ কিউবিক কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয়। এই প্রবণতা দেশের বরেন্দ্রসহ বিভিন্ন এলাকার পানির স্তর বিপজ্জনক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নেপালের কৃষকেরা ২ কোটি ৩০ লাখ সেচপাম্পের মাধ্যমে তাঁদের সেচের পানি উত্তোলন করেন, যা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামিয়ে দিয়ে বড় ধরনের পরিবেশগত ঝুঁকি তো তৈরি করছেই, সেই সঙ্গে এই পানি তুলতে তাঁদের বছরে ৩৭৮ কোটি ডলার খরচ করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী হাফিজ উল্লাহ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হিসাবে পাঁচ বছর আগে দেশের ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা ৮২ শতাংশ পানি সেচকাজে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে তা কমে ৭৭ শতাংশ হয়েছে। সরকার ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ায় সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
পানি নিরাপত্তা
জাতীয় পানি নিরাপত্তা ইনডেক্সের তালিকায় ৪৮টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুর। নিচের দিক থেকে শীর্ষে বা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে আফগানিস্তান। ৪৬, ৪৫ ও ৪৪তম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ।
প্রতিবেদনটিতে জাতীয় পানি নিরাপত্তা ইনডেক্স তৈরি করা হয়েছে যে পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে সেগুলো হলো গৃহস্থালি পানি নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক পানি নিরাপত্তা, নগরের পানি নিরাপত্তা, পরিবেশগত পানি নিরাপত্তা ও পানিসংক্রান্ত দুর্যোগ সহিষ্ণুতা।
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ওয়ালি উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখনো প্রতিবেদনটি দেখিনি, তাই না দেখে কোনো মন্তব্য করব না।’
পানিবিষয়ক এই প্রতিবেদন তৈরির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এডিবির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা এক হাজার কোটি হবে। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোতে খাবার ও পানির চাহিদা বাড়বে। এই সময়ের মধ্যে গৃহস্থালি কাজে পানির চাহিদা ৫৫ শতাংশ ও কৃষিতে ৬০ শতাংশ বাড়বে। ফলে পানির টেকসই ব্যবহার এবং পানির উৎসগুলো সংরক্ষণের দরকার হবে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পানি নিরাপত্তার চিত্র তুলে ধরতেই এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সুত্রঃ প্রথম আলো কৃপ্র/ এম ইসলাম