চাষা আলামীন জুয়েল: মুরগির জাত বা ধরনঃ ব্রয়লার মুরগি কি-—? ব্রয়লার হলো দ্রুত সময়ে ও অধিক মাংস উৎপাদনের জন্য এক বিশেষ ধরনের মুরগি, যাদের দেহের ওজন ৩০ থেকে ৩৫ দিনে দেড় থেকে পৌনে দু’কেজি হয়। ঐ সময়ে এরা এক কেজি দেহের ওজনের জন্য মোটামুটি দেড় কেজি খাবার খাবে। এদের মাংস খুব নরম ও সুস্বাদু।
হাইব্রিড ব্রয়লারঃ— ভারী ওজন বিশিষ্ট বিভিন্ন মোরগ-মুরগির মধ্যে মিলন ঘটিয়ে, ছাটাই বাছাই করে দীর্ঘ গবেষণার পর কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে অধিক মাংস উৎপাদনশীল হাইব্রিড ব্রয়লার তৈরি করা হয়।
ব্রয়লার জাতের নামঃ--হাইব্রো পিএন, হাববার্ড ক্লাসিক, কব ৫০০, হাইব্রো পিজি + আরবার একর ও ষ্টারব্রো, ইত্যাদি।
ব্রয়লার মুরগি নির্বাচনঃ— গুণগতমানের ব্রয়লার বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে, ব্রয়লারের জন্য খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে এমন মুরগির জাত সঠিক ভাবে নির্বাচন করতে হবে। কারণ সব মুরগি সমান ভাবে ওজন বাড়ে না।
লেয়ার মুরগির সংজ্ঞাঃ— লেয়ার মুরগি হলো ডিম উৎপাদনের জন্য বিশেষ ধরনের মুরগি, যাদেরকে একদিন বয়স থেকে পালন করা হয়, যারা ১৯ থেকে ২০ সপ্তাহ বয়সে ডিম দিতে শুরু করে এবং উৎপাদনকাল ৭২ থেকে ৭৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ডিম উৎপাদনকালীন সময়ে এরা গড়ে প্রায় সোয়া দু’কেজি খাবার খেয়ে এক কেজি ডিম উৎপাদন করে।
হাইব্রিড লেয়ারঃ—- ডিম উৎপাদনের উদ্দেশ্যে কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন ধরনের মোরগ-মুরগির মিলন ঘটিয়ে ক্রমাগত ছাঁটাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ গবেষণার পর সৃষ্ট অধিক ডিম পাড়া মুরগিকে হাইব্রিড লেয়ার বলে।
লেয়ার জাতের নামঃ— ডিমের প্রকৃতি বা রং অনুসারে লেয়ার মুরগি দুই ধরনের। ১। সাদা ডিম উৎপাদনকারীঃ এরা তুলনামূলক ভাবে আকারে ছোট। তুলনামূলকভাবে কম খাদ্য খায়, ডিমের খোসার রং সাদা। যেমন: ইসা হোয়াইট, সিভার কার্প, লোহম্যান হোয়াইট, নিকচিক, ব্যবকক-বিভি-৩০০, হাবার্ড হোয়াইট, হাই সেক্স হোয়াইট, শেভার হোয়াইট, হাইলাইন হোয়াইট, বোভান্স হোয়াইট।২। বাদামী ডিম উৎপাদনকারীঃ তুলনামূলকভাবে আকারে বড়, খাদ্য বেশি খায়, ডিমের আকার বড়, ডিমের খোসার রং বাদামী। যেমন: ইসা ব্রাউন, হাই সেক্স ব্রাউন, শেভার ৫৭৯, লোহম্যান ব্রাউন, হাই লাইন ব্রাউন, ব্যবকক-বিভি-৩৮০, গোল্ড লাইন, ইসা রোজ, ব্যবলোনা টেট্রা, ব্যবালোনা হারকো, হাবার্ড ব্রাউন।
লেয়ার মুরগি নির্বাচনঃ—- লেয়ারের জন্য সঠিকভাবে ভাল উৎপাদনশীল স্ট্রেইন নির্বাচন করতে হবে। কারণ সব মুরগি সমান ডিম দেয় না।
গুণগতমানের লেয়ার বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের সুনাম রয়েছে এমন বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে। সুনাম রয়েছে এমন হ্যাচারী থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।
বাচ্চা গ্রহণের প্রস্ততিঃ-— বাচ্চা খামারে আসার পরের কাজঃ জন্মের প্রথম সপ্তাহে পরিবহনজনিত কারণে বাচ্চা পানি শূন্যতায় ক্লান্ত হয়। তাই এদের জন্য ব্রুডার ঘরে পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দ্রুত পানি পান করা শেখাতে হবে। পানির সাথে শতকরা ৫ ভাগ হারে গ্লুকোজ মিশিয়ে দিলে সহজে এরা সেখান থেকে শক্তি পেতে পারে। একইসাথে যে কোন উন্নতমানের মাল্টিভিটামিন ও ইলেক্ট্রোলাইট প্রস্ততকারী কোম্পানীর নির্দেশ মতো পানিতে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। দূরের হ্যাচারী বা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে বাচ্চা পরিবহন করে খামারে আনলে এবং মাল্টিভিটামিন ও ইলেক্ট্রোলাইট ব্যবহার করা হলে,পরিবহনজনিত ক্লান্তি ও পানি শূণ্যতা দূর করে বাচ্চাকে দ্রুত স্বাভাবিক করে তোলে।
টিকাদান কর্মসূচিঃ—-টিকা প্রদান ও তার গুরুত্বঃ টিকা প্রদান কর্মসূচি অনুসারে বিভিন্ন রোগের টিকা প্রদান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি সৃষ্টি হয় এবং সংক্রামক রোগ হতে মুরগিকে রক্ষা করা যায়। টিকাদান ফলপ্রসূ হলে রোগের প্রাদুর্ভাব খুব কম হবে এবং মৃত্যুর হার সহনীয় পর্যায় রাখা যাবে।
লেয়ার মুরগির টিকাঃ–— মারেক্স, রাণীক্ষেত, গামবোরো, ব্রংকাইটিস, বসন্ত, সালমোনেলা, করাইজা ।
ব্রয়লার মুরগির টিকাঃ মারেক্স, রাণীক্ষেত, গামবোরো।
টিকা প্রদানের পূর্বে সতর্কতাঃ— মুরগি ধরার সময় যত্ন সহকারে ধরতে হবে,
মুরগিকে যে কোন ধরনের ধকল মুক্ত অবস্থায় টিকা প্রয়োগ করতে হবে,
অসুস্থ মুরগিকে কোন অবস্থাতেই টিকা দেয়া যাবে না, টিকা প্রদান উপকরণ ফুটন্ত পানিতে সিদ্ধ করে নিতে হবে, আবহাওয়া যখন ঠান্ডা সেসময়ে টিকা প্রদান করতে হবে।
টিকা ব্যবহারের সাধারণ নিয়মাবলীঃ— প্রতিষেধক টিকা সবসময়ই সুস্থ পাখিকে প্রয়োগ করতে হয়, সংক্রামক রোগ বা কৃমিতে আক্রান্ত পশু-পাখিকে টিকা প্রয়োগ করা যাবে না। তাতে কাঙ্খিত মাত্রায় প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয় না বরং পাখির আরও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে,টিকা বীজ কোন অবস্থাতেই সূর্যালোকের সংস্পর্শে আনা যাবে না,ব্যবহারের সময় মিশ্রণ এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে পাত্র, সিরিঞ্জ-নিড্ল, ব্যবহৃত তরল পদার্থ, টিকা ব্যবহারকারীর হাত ইত্যাদি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত হওয়া প্রয়োজন,জীবাণুমুক্তকরণের জন্য রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা যাবে না,
প্রতিষেধক টিকা সকালে বা সন্ধ্যার সময় ঠান্ডা আবহাওয়ায় প্রয়োগ করা ভাল,ব্যবহারের জন্য গোলানোর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিকা ব্যবহার করে ফেলা উচিত। গোলানোর পর গরমের দিনে ১ ঘন্টা এবং শীতের দিনে ২ ঘন্টার মধ্যে ব্যবহার করে ফেলতে হবে,মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বা টিকার সাধারণ রং পরিবর্তিত হয়ে গেলে, সে টিকা আর ব্যবহার করা যাবে না, টিকা পরিবহনের ক্ষেত্রে ঠান্ডা অবস্থায় পরিবহন নিশ্চিত করা প্রয়োজন, তাপ প্রতিরোধক পাত্রের মধ্যে বরফ দিয়ে টিকা বীজ পরিবহন করতে হয়। বরফ গলে গেলে পুনরায় বরফ দিতে হয়,ব্যবহারের সময় টিকা মিশ্রণের পাত্র ছায়াযুক্ত স্থানে বরফ দেওয়া বড় পাত্রের মধ্যে রাখা যাবে না,ভাইরাস জনিত রোগ প্রতিরোধক টিকা প্রয়োগকালে টিকা প্রয়োগ স্থান পরিষ্কার পানি দ্বারা ধুয়ে নিতে হবে এবং এই জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাবে না,গোলানো অব্যবহৃত টিকা পুড়িয়ে ফেলতে হবে, ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য রাখা যাবে না।
টিকা প্রদান কর্মসূচী (লেয়ার মুরগির জন্য)—-
বয়স—–রোগের নাম—–ভ্যাকসিনের নাম—টিকা প্রদানের পদ্ধতি
১ দিন—মারেক্স রোগ—–মারেক্স ভ্যাকসিন–চামড়ার নীচে ইজেকশন।
২ দিন-গামবোরো রোগ-গামবোরো ভ্যাকসিন (লাইভ)-চোখে ফোঁটা (প্যারেন্ট মুরগির টিকা প্রদান করা না থাকলে)।
৩-৫ দিন-রানীক্ষেত রোগ–বি, সি, আর, ডি, ভি–দুই চোখে ফোঁটা (প্যারেন্ট মুরগির টিকা প্রদান করা থাকলে ৭ থেকে ১০ দিন বয়সে)।
৭ দিন-ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস–আই, বি,—–চোখে ফোঁটা
১০-১৪ দিন–গামবোরো রোগ-গামবোরো ভ্যাকসিন–এক চোখে ফোঁটা
২১-২৪ দিন–রানীক্ষেত রোগ–বি, সি, আর, ডি, ভি–দুই চোখে ফোঁটা
২৪-২৮ দিন–গামবোরো রোগ–গামবোরো ভ্যাকসিন-এক চোখে ফোঁটা
৩০ দিন-ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস–আই, বি,—–চোখে ফোঁটা
৩৫ দিন—মুরগি বসন্ত–ফাউল পক্স ভ্যাকসিন–চামড়ার নীচে ইনজেকশন
৫০ দিন——কৃমি——কৃমির ঔষধ———খাদ্য অথবা পানির সাথে
৬০ দিন–রানীক্ষেত–আর, ডি, ভি—চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন
৭০ দিন-ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস–আই, বি–চোখে ফোঁটা বা পানির সাথে
৮০-৮৫ দিন-কলেরা–ফাউল কলেরা ভ্যাকসিন—চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন।
৯০-৯৫ দিন–ইনফেকসাস করাইজা–আই, করাইজা ভ্যাকসিন–চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন।
১১০-১১৫ দিন–কলেরা–ফাউল কলেরা ভ্যাকসিন—চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন।
১৩০-১৩৫ দিন–ইনফেকসাস ব্রংকাইটিস, রানীক্ষেত, এগড্রপসিনড্রম—সমন্বিত টিকা—চামড়ার নীচে বা মাংসে ইনজেকশন।
১৩০-১৩৫ দিন—কৃমি—কৃমির ঔষধ—-খাদ্য অথবা পানির সাথে।
#বিশেষ সতর্কতা-– প্রয়োজনবোধে খাদ্যের সাথে ৬ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ককসিডিওসিস রোগ প্রতিরোধের জন্য ককসিডিওস্ট্যাট ব্যবহার করতে হবে। এই তালিকা সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। রোগের প্রার্দুভাবের ইতিহাস, টিকার প্রাপ্যতা ও স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নিজ নিজ খামারের জন্য নিজস্ব তালিকা প্রস্তত করতে হবে। টিকা সবসময় প্রস্ততকারীর নির্দেশমত ব্যবহার করতে হবে। সকল প্রকার টিকা ও ঔষধ প্রয়োগের পূর্বে পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। (চলবে)
* সকল কৃষক ভাই- বোনদের জন্য শুভ কামনায়— চাষা আলামীন জুয়েল *
কৃপ্র/ এম ইসলাম