কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সুন্দরবনের বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় নতুন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বনের অর্ধেক এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা, ভ্রমণের জন্য পর্যটকসহ সব প্রবেশের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ ও সুন্দরবনের স্বতন্ত্র ফোর্স দিয়ে টহলদারি আরও জোরদার করা। এসব ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করা হবে।
এ ছাড়া কিছু কিছু জায়গায়ও উচ্চ শব্দের মাইক ও ট্রলার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে জানা গেছে। বনে বাঘের স্বাভাবিক জীবনচক্রের জন্য যে স্বাদু পানি, শিকার ও গহিন জঙ্গল ছাড়াও নিরুপদ্রব প্রজননব্যবস্থা থাকা দরকার তার কোনোটাই বর্তমানে যথেষ্ট নয়। সেজন্যই সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়ে না। নতুন করে যুক্ত হয়েছে বাঘের শাবক পাচার, পিটিয়ে ও গুলি করে বাঘ হত্যার ঘটনা। কয়েক বছর আগে সাতক্ষীরার বন থেকে চুরি করা তিনটি বাঘশাবক ঢাকায় ধরা পড়ার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে, পাচারকারী চক্র চামড়া বিক্রির জন্য শুধু বাঘই হত্যা করছে না, তারা শাবকও দেশে-বিদেশে পাচার করছে।
বাঘ বাঁচাতেই বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩টি দেশ একসঙ্গে প্রতি বছরের ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস পালন করে। এ বিষয়ে প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাঘ সুন্দরবনের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষায় শিগগিরই নতুন ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করবে বন বিভাগ। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাঘ বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল ওয়াদুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুন্দরবনে বাঘের জীবনচক্র স্বাভাবিক থাকলে এর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ারই কথা।
২০১৫ সালের বাঘশুমারিতেও এর সংখ্যা ১০৬-এর বেশি পাওয়া যায়নি। এর আগে দফায় দফায় এ সংখ্যা কমবেশি হলেও বাঘের সংখ্যা এখনো কোনোভাবেই বাড়ছে না। এজন্য ক্যাপটিভ বাঘ শাবক লালন-পালনের ওপর জোর দেন তিনি। বাঘ বিশেষজ্ঞ ও উপ-প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুন্দরবনে পুরুষ বাঘ সংখ্যায় বেশি, বাঘিনী কম। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর একটি বাঘিনী একবারে দুই থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। একেকটি বাঘিনী সচরাচর দুবার বাচ্চা ধারণ করে। এর স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া ও নিরুপদ্রব আবাসন নিশ্চিত করা গেলে বাঘের সংখ্যা এতদিনে আরও বৃদ্ধি পেতে পারত। সুন্দরবনের ভারতীয় এলাকায় এ ধরনের নিরাপদ প্রজননব্যবস্থা থাকায় সেখানে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে এমন তথ্য বন বিভাগের বন্যপ্রাণী বিভাগ জানতে পেরেছে।
জানা গেছে, বাঘিনী বাচ্চা দেওয়ার পর শাবকের ওপর নজর পড়ে বাঘের। যে কোনোভাবে বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলার জন্য সব সময়ই তত্পর থাকে বাঘ। জানা যায়, জন্ম দেওয়ার পর থেকে বাঘিনী শিকার ধরা ছাড়াও স্বাভাবিক চলাফেরা সম্পূর্ণ বন্ধ করে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকে। এ সময় বাঘিনী চারদিকে নির্ঘুম দৃষ্টি রাখে। বাচ্চাগুলো মায়ের সঙ্গে চলাফেরার যোগ্য হয়ে ওঠা পর্যন্ত এই নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করে বাঘিনী।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে তিনটি বাঘশাবক কীভাবে পাচারকারীরা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে অপহরণ করে তা ভাবিয়ে তুলেছিল সবাইকে। জানা গেছে, মিষ্টি পানির অভাবে সুন্দরবনের নদ-নদীর অতিমাত্রার লবণাক্ত পানি খেয়ে বাঘ আক্রান্ত হচ্ছে জন্ডিস, লিভার সিরোসিসসহ নানা রোগে। অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়া বাঘ-বাঘিনী আহার হিসেবে মানুষের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। একই কারণে লোকালয়ে এসে তারা মারাও পড়ছে। এসব কারণেও বাঘের সংখ্যা ক্রমে কিছুটা হ্রাস পাচ্ছে।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সুন্দরবন অঞ্চলে ৩৯টি বাঘ হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বাঘ আটক হয় চারটি। বাঘ গবেষকরা বলেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাওয়ায় বাঘের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ এলাকার সুন্দরবনের বাঘ স্থান পরিবর্তন করে। বনে গভীর জঙ্গল না থাকায় বাঘ তার নিরাপদ আবাসন হারিয়েছে। বিশ্লেষকরা আরও বলেন, বাঘ সচরাচর নিঃশব্দ এলাকা পছন্দ করে। অথচ সুন্দরবনে নানা ধরনের শব্দ বিশেষ করে পটকাবাজি ও বাঘের এলাকায় মানুষের পদচারণা বাঘের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। এ ছাড়া ১৯৮৮-এর ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭-এর সিডর ও ২০০৯-এর আইলার মতো প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের মুহূর্তেও জীবন হয়ে পড়েছিল বিপন্ন। এ সময় অনেক বাঘের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন/ কৃপ্র/এম ইসলাম