‘বিশ্বের ৬০ শতাংশ ইলিশই আহরিত হয় বাংলাদেশে’
এস এম মুকুল: দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১৩ ভাগ যার আনুমানিক অর্থমূল্য আট হাজার ১২৫ কোটি টাকা আসে ইলিশ মাছ থেকে। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় দুই শতাংশ। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। প্রতিবছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ আট মাস জাটকা শিকার বন্ধ থাকলে ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পরিপক্ব ইলিশ পাওয়া যাবে।
ভরা মৌসুমে ইলিশের বাজার চড়া। মাছ ধরা ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যস্ত জেলেরাইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ এবং জাতীয় সম্পদ। দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১৩ ভাগ যার আনুমানিক অর্থমূল্য আট হাজার ১২৫ কোটি টাকা আসে ইলিশ মাছ থেকে। জিডিপিতে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় দুই শতাংশ। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণে সরাসরি এবং ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ইলিশ আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। পৃথিবীর সব দেশেই এ মাছের চাহিদা রয়েছে। দেশের মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইলিশের অবদান ১২%। প্রতিবছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। সরকার ঘোষিত নিষিদ্ধ আট মাস জাটকা শিকার বন্ধ থাকলে ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পরিপক্ব ইলিশ পাওয়া যাবে। এতে বছরে সাত হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টি সম্ভব হবে বাংলাদেশে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে বিশ্বে প্রতিবছর পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়। এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। ফলে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১১ শতাংশ। সার্বিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় জিডিপিতে এর হিস্যা এক শতাংশের সমপরিমাণ। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন তিন থেকে চার লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে ওঠানামা করছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ মেট্রিক টনের মতো। এই হিসাবে প্রচলিত বাজারমূল্যে প্রতি কেজির গড় দাম কম করে ৬৫০ টাকা ধরা হলেও সংগৃহীত সাড়ে তিন লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এই হিসাবে চলতি মৌসুমে ৭০-৭৫ ভাগ মা ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ায় এর বাজার মূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা।
উৎপাদনে পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ
বছরে পর পর নিরলস ও শ্রমলব্ধ গবেষণার ফলাফল থেকে পাওয়া তথ্যে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, ইলিশের পোনা জাটকা অবাধে নিধন এবং ডিমওয়ালা ইলিশসহ নির্বিচারে ইলিশ আহরণই এ মাছের চরম সংকট সৃষ্টির প্রধান কারণ। বিজ্ঞানীরা ইলিশ উন্নয়ন ও সংরক্ষণের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং এর ওপর ভিত্তি করে ইলিশ মাছ রক্ষার জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় পরামর্শ উপস্থাপন করেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার আইন করে জাটকা মৌসুমে জাটকা নিধন এবং ডিম ছাড়ার দিনগুলোয় ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা বন্ধের নির্দেশ জারি করে। এরপর শুরু হয় জাটকা নিধন বন্ধের অভিযান ও জনসচেতনতা সৃষ্টির পরিকল্পিত কার্যক্রম। জাটকা নিধন ও ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ করা না গেলেও প্রতিবছর ইলিশ আহরণের পরিমাণ বাড়ছে। মাছবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী- ইলিশ পাওয়া যায় বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে বাকি ১০টিতেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতিবছর আট থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৬৫ ভাগই বাংলাদেশের। বাদ বাকি ১৫ শতাংশ ভারত ও ১০ শতাংশ মিয়ানমার এবং বাকি ১০ শতাংশ আটলান্টিক, প্রশান্ত ও আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় উৎপন্ন হয়। নদী গবেষণা কেন্দ্রের এক তথ্যে জানা গেছে, দেশের ১৫টি জেলায় ৮৫টি উপজেলায় ইলিশ উৎপাদনের ভেতর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি জোরদার করা ও অভয়াশ্রমগুলোয় মা মাছ আহরণ বন্ধ রাখা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে নয় ভাগ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১০ ভাগ, ২০০৮ সালে ৩৮ ভাগ, ২০০৯ সালে ১৭ ভাগ, ২০১০ সালে ৩৩ ভাগ, ২০১১ সালে ৩৬ ভাগ, ২০১২-১৩ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪ ভাগ ২০১৩-১৪ সালে ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বরিশাল মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, দেশের ১০০টি নদীতে কমবেশি ইলিশ পাওয়া গেলেও ইলিশের প্রজনন ও পরিপক্বতা দক্ষিণাঞ্চলের নদীতেই হয়। দেশে মোট উৎপাদিত জাটকার ৬০-৭০ ভাগ দক্ষিণের বিষখালী, পায়রা, আগুনমুখা, বুড়িশ্বর, বলেশ্বর ও কীর্তনখোলা নদী থেকে আহরণ করা হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই চার মাসেই মোট জাটকার ৪৫-৬৫ ভাগ নিধন করা হয়।
জাটকা ধরা বন্ধের সুফল
২০০২ সাল থেকে ইলিশের ডিমপাড়া ও বিচরণের স্থানগুলো চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ। সে স্থানগুলোয় ইলিশ ধরা এবং বছরের আট মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ। তা ছাড়া ডিম পাড়ার ১৫ দিন সব ধরনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। ইলিশ ধরেন জীবিকা নির্বাহ করে এমন ১৫টি জেলার ২ লাখ ২৪ হাজার ১০২ জেলেকে পরিচয়পত্র দিয়ে তাদের বছরে তিন মাস সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে সরকার। দেশের ইলিশ রক্ষার এই কৌশল খুবই কার্যকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে অন্য দেশের কাছে।
জাটকা নিধন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হওয়ায় এই সাফল্য এসেছে। জাটকা নিধন পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হলে প্রতিবছর ২১ থেকে ২৪ হাজার কোটি নতুন পরিপক্ব ইলিশ আহরণ সম্ভব হবে। যার ফলে বছরে সাত হাজার কোটি টাকা মূল্যের ইলিশের বাজার সৃষ্টি হবে। আহরিত ইলিশের সামান্য পরিমাণ রপ্তানি করে প্রতিবছর ১৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। জানা গেছে, প্রতিবছর ভারত ও মিয়ানমারে ইলিশ রপ্তানি হয় আট হাজার থেকে নয় হাজার টন। ৮০০ থেকে ৯০০ টন রপ্তানি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। উল্লেখ্য, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল প্রায় তিন লাখ টন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে সাড়ে তিন লাখ টন এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় চার লাখ টন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাড়ছে ইলিশের আকার
ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ একযুগের প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে ইলিশের আকৃতি বড় হওয়া এমনকি বড় আকৃতির ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে। মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশে ধরা পড়া ১৭ হাজার ইলিশের ওপর গবেষণা চালিয়ে বলছে, বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে ধরা পড়া ইলিশের আকৃতি ও ওজন বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের তিন বছর ধরে চলা গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ধরা পড়া ইলিশের আকৃতি ও সংখ্যার এই বদল ২০১৩ সালে গড়ে ৫১০ গ্রাম, ২০১৪ সালে ৫৩৫ গ্রাম, ২০১৫ সালে ৬২৮ গ্রামের অধিকহারে ইলিশ ধরা পড়েছে। এটি আশার খবর বটে_ এক কেজি গড় ওজনের ইলিশ মাছ বাংলাদেশে ফিরতে শুরু করেছে। নদী কেন্দ্র্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ২০১২ সালে ধরা পড়া ইলিশ ২০০ গ্রামের চেয়ে কম ২৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে প্রায় ২০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ১৯ শতাংশ এবং ২০১৬-তে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। আরো সুখব হলো_ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ গবেষণা অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে জেলেদের জালে জাটকা ওঠার পরিমাণ আট দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ধরা পড়েছে ২০ শতাংশ বেশি।
উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হলে
মা ইলিশ আহরণ বন্ধ করা। জাটকা না ধরে বড় ইলিশ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। ইলিশের অভয়াশ্রম সংরক্ষণ করা। প্রজননকালে ইলিশ আহরণ থেকে জেলেদের বিরত রাখতে হবে। সরকারের প্রচারণায় জনগণেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। বিশাল চাহিদার ইলিশ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন নদী-নালা, খাল-বিলে কিংবা পুকুরেও চাষাবাদ করা যায় কিনা সে ব্যাপারে গবেষণা করা। ইলিশ মাছের অধিক ডিম উৎপাদনের জন্য ডিমওয়ালা মাছ সংরক্ষণ ও অবাধ প্রজনন সুবিধা সৃষ্টি করা। জাটকা সংরক্ষণ এবং অতি আহরণ মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। ইলিশের আবাসস্থলের পরিবেশ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও জেলেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। ইলিশের আহরণ পরিসংখ্যান ও গবেষণা প্রকল্প জোরদার করা। ইলিশের চোরাচালান বন্ধ করা। দেশের মানুষ যাতে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে দেশের সেরা জাতীয় মাছ খেতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা।
বাঙালির পাতে ইলিশ চাই
তবুও জাতীয় মাছ ইলিশ বলে কথা। এক হিসাবে দেখা গেছে, মৌসুম ছাড়া একজোড়া ইলিশ কিনতে প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তার বেতনের ১০ শতাংশ ব্যয় করতে হয়। স্বাদে-গন্ধে এর অতুলনীয় স্বাতন্ত্র্যের জন্যই বাঙালির রসনা-পার্বণে ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে ঠাঁই নিয়েছে ইলিশ। বাংলার মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের সংসারে এক মাসে এক হাজার টাকার বেশি মাছ কেনার সামর্থ্য কটি পরিবারের আছে। উৎপাদন বাড়লেও দিন দিন সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে বাঙালির প্রিয় মাছ ইলিশ। কেজির দরে ইলিশ কেনার সামর্থ্য খুব কম পরিবারেই আছে।
লেখক : এস এম মুকুল লেখক : কৃষি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
কৃপ্র/ এম ইসলাম