কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ অগ্রহায়ণ মাস আসতে এখনো অনেক দিন। চলছে আশ্বিনের মাঝামাঝি সময়। একসময় এ মাসেই লালমনিরহাটের ঘরে ঘরে হানা দিত মঙ্গার ভয়াল থাবা। কিন্তু কালের বিবর্তনে সবকিছুই যেন পাল্টে গেছে। এখন আর অগ্রহায়ণ মাসের অপেক্ষা নয়, আগাম জাতের ধান চাষ করে এ অঞ্চলের কৃষক আশ্বিন-কার্তিক মাসেই মঙ্গা জয় করতে শিখেছেন। চলতি মাসেই লালমনিরহাটসহ রংপুর বিভাগের আট জেলার বিভিন্ন এলাকায় আগাম জাতের আমন ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। এসব ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হওয়ায় কৃষকের মুখে দেখা দিয়েছে হাসির ঝিলিক। খবর বাংলাদেশ প্রতিদিন অনলাইনের।
কৃষকবধূরাও থেমে নেই। ধান কেটে বাড়ি আনার পর মাড়াই, শুকিয়ে ঘরে তোলার কাজ করছেন কৃষকবধূরা। আগাম আমন ধানের ফলনও হয়েছে ভালো। কৃষকরা বলছেন, আগাম আমন চাষে মঙ্গা উধাও হয়ে গেছে। ধানের দাম ভালো থাকায় চাষিদের মনও উত্ফুল্ল। অন্যদিকে মজুরি বেশি থাকায় কৃষিশ্রমিকরা রয়েছেন চাঙা। ধান কাটা ও মাড়াই করতে কৃষিশ্রমিক পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়েছে। দিন হাজিরায় আড়াই থেকে ৩০০ টাকা দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
চলতি আমন মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের আট জেলায় ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ৪৯ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে উৎপাদন ধরা হয়েছে ৩৩ লাখ ৮৮ হাজার ৯৬৩ মেট্রিক টন চাল। এর মধ্যে আগাম জাতসহ হাইব্রিড চাষ হয়েছে প্রায় ৭ লাখ হেক্টর জমিতে, যা মোট আবাদি জমির ৪৩ শতাংশ। এবারের আমন আবাদের শুরুটা মোটেও ভালো ছিল না। প্রথম থেকেই কৃষকের মধ্যে ছিল শঙ্কা। প্রথমত, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়া, দ্বিতীয়ত অকালবন্যা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের মাথায় হাত পড়ে। আমনের যে টার্গেট তারা করেছিল, তা পূরণ না হওয়ার শঙ্কাই দেখা দেয়।
বর্ষাকাল পেরিয়ে যাওয়ার পর আকাশে কালো মেঘের আনাগোনায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তারপর বন্যার আঘাত। সবকিছু মোকাবিলা শেষে মাঠ ঘুরে দেখা যায় আমনের ফলন এবার ভালোই হবে। তবে বিভিন্ন আগাম আমনের জাত যে এখন ৭৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ফলন দিতে পারে, তা অবাক করে দিয়েছে কৃষকদের। দিন মাস বছর যতই পার হচ্ছে, ততই যেন নতুন নতুন আগাম জাতের আমন ধান কৃষককে উজ্জীবিত করছে।
কৃষকরা জানান, তিন বছর আগেও এক একর জমির ধান কাটা ও মাড়াই করতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাগত। এবার প্রায় তিনগুণ বেশি মজুরি দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে দিন হাজিরায় যেসব শ্রমিক কাজ করতেন, তাদেরও মজুরি দ্বিগুণ হয়েছে। দু-তিন মৌসুম আগে ১০০ টাকায় যে শ্রমিক দিন হাজিরায় কাজ করতেন, এবার তারা ২৫০ টাকার নিচে কাজ করছেন না। কোনো কোনো স্থানে তিন বেলা খাওয়াসহ ৩০০ টাকা হাজিরা পাচ্ছেন। বাস্তবতায় অগ্রহায়ণ মাসের আমন ওঠার আগে আগাম জাতের অনেক ধানের আবাদও হচ্ছে রংপুর অঞ্চলে। সেই ধান এখন ঘরে উঠছে। আগাম এই আবাদ এ অঞ্চলে আশ্বিন-কার্তিক মাসের অভাব বা মঙ্গা দূর করেছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবিত ব্রি-৩৩ ও বাংলাদেশ আণবিক কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) উদ্ভাবিত বিনা-৭ ধান আমনের আগে ফলন দিয়েছে। ব্রি-৩৩ ও বিনা-৭ আবাদে খরচ তেমন নেই। বিঘাপ্রতি উৎপাদন ১৬ থেকে ১৮ মণ। এ অঞ্চলে এখন সারা বছর কোনো না কোনো জাতের ধানের আবাদ হচ্ছে। ধানের ‘নির্দিষ্ট মৌসুম’ দিনে দিনে উঠে যাচ্ছে। এই আবাদে ফসল ঘরে উঠতে সময়ও লাগে কম। ৭৫ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে ফসল ঘরে তোলা যায়। ব্রি-৫৪ পর্যন্ত জাত উদ্ভাবিত হয়েছে।
বর্তমানে আমন মৌসুমে যে ধান হয়, তা ব্রি-৪৯, বিআর-১১, বিআর-৩২। হালে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প সময়ে ফলনের এক জাতের ধান উদ্ভাবন করেছে। বিএইউ-১ জাতের এই ধানকে বলা হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ ধান। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় বিনা-৭ ও ব্রি-৩৩ জাতের (উফশী) ফলন মিলেছে প্রতি হেক্টরে ২ দশমিক ৯৪ মে. টন থেকে ৩ মে. টন পর্যন্ত। এই আবাদ পেয়ে লালমনিরহাটের কৃষক খুশি। রংপুর কৃষি অঞ্চলের লালমনিরহাট জেলা সদর, আদিতমারী, কালিগঞ্জ, হাতিবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলায় আগাম আমন ধান কাটা ও মাড়াই চলছে ধুমছে। কৃষকরা ঘরে ধান তুলছেন। এরপর পুনরায় সেই জমি তৈরি করে সেখানে আবাদে নামবেন আগাম আলু ও সরিষা। এলাকার কৃষক সালাম, রমজান, রোকন, মোক্তার, আমিনুলসহ অনেকে জানান, এবার আগাম আমন ধান আবাদ ভালোই হয়েছে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম