কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ: ১. আলুর মড়ক বা নাবি ধ্বসা (লেইট ব্লাইট) রোগ : ফাইটপথোরা ইনফেসটেনস নামক ছত্রাকের আক্রমণে আলুর মড়ক বা নাবি ধ্বসা (লেইট ব্লাইট) রোগ হয়ে থাকে। প্রথমে পাতা, ডগা ও কান্ডে ছোট ভিজা দাগ পড়ে। ক্রমে দাগ বড় হয় ও সমগ্র পাতা, ডগা ও কান্ডের কিছু অংশ ঘিরে ফেলে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যেই জমির অধিকাংশ ফসল আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভোরের দিকে আক্রান্ত পাতার নীচে সাদা পাউডারের মত ছত্রাক চোখে পড়ে। আক্রান্ত ক্ষেতে পোড়া পোড়া গন্ধ পাওয়া যায় এবং মনে হয় যেন জমির ফসল পুড়ে গেছে।
২. আলুর আগাম ধ্বসা বা আর্লি ব্লাইট রোগ : আলটারনারিয়া সোলানাই নামক ছত্রাকের আক্রমণে আলুর আগাম ধ্বসা বা আর্লি ব্লাইট রোগ হয়ে থাকে। নীচের পাতা ছোট ছোট বাদামী রংয়ের অল্প বসে-যাওয়া কৌণিক দাগ পড়ে। আক্রান্ত অংশে সামান্য বাদামী এলাকার সাথে পর্যায়ক্রমে কালচে রংয়ের চক্রাকার দাগ পড়ে। পাতার বোঁটা ও কান্ডের দাগ অপেক্ষাকৃত লম্বা ধরণের হয়। গাছ হলদে হওয়া, পাতা ঝরে পড়া এবং অকালে গাছ মরে যাওয়া এ রোগের লক্ষণীয় উপসর্গ। আক্রান্ত টিউবারের গায়ে গাঢ় বাদামী থেকে কালচে বসে যাওয়া দাগ পড়ে।
৩. কান্ড ও আলু পচা রোগ : স্কেলারোসিয়াম রল্ফসি নামক ছত্রাকের আক্রমণে কান্ড ও আলু পচা রোগ হয়ে থাকে। এ রোগের আক্রমণের ফলে বাদামী দাগ কান্ডের গোড়া খেয়ে ফেলে। গাছ ঢলে পড়ে এবং পাতা বিশেষ করে নীচের পাতা হলদে হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে বা আশেপাশের মাটিতে ছত্রাকের সাদা সাদা জালিকা দেখা যায়। কিছু দিন পর সরিষার দানার মত রোগ জীবাণুর গুটি বা স্কেলারোসিয়া সৃষ্টি হয়। আলুর গা থেকে পানি বের হয় এবং পচন ধরে। ক্রমে আলু পচে নষ্ট হয়ে যায়।
৪. আলুর স্টেম ক্যাঙ্কার স্কার্ফ রোগ : রাইজকটোনিয়া সোলানাই নামক ছত্রাকের আক্রমণে আলুর স্টেম ক্যাঙ্কার স্কার্ফ রোগ হয়ে থাকে। গজানো অঙ্কুরের মাথায় এবং স্টেলনে আক্রমণের দাগ দেখা যায়। বড় গাছের গোড়ার দিকে লম্বা লালচে বর্ণের দাগ বা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। কান্ডের সাথে ছোট ছোট টিউবার দেখা যায়। আক্রান্ত টিউবারের গায়ে শক্ত কালচে এবং সুপ্ত রোগ জীবাণুর গুটি দেখা যায়।
৫. ঢলে পড়া এবং বাদামী পচন রোগ : সিউডোমোনাস সোলানেসিয়ারাম নামক ছত্রাকের আক্রমণে ঢলে পড়া এবং বাদামী পচন রোগ হয়ে থাকে। গাছের একটি শাখা বা এক অংশ ঢলে পড়তে পারে। পাতা সাধারণত হলুদ হয় না এবং সবুজ অবস্থায়ই চুপসে ঢলে পড়ে। গোড়ার দিকে গাছের কান্ড ফেলে দেখলে বাদামী আক্রান্ত এলাকা দেখা যায়। ঢলে পড়া গাছ খুব দ্রুত চুপসে যায়। আক্রান্ত আলু কাটলে ভিতরে বাদামী দাগ দেখা যায়। আলুর চোখ সাদা পুঁজের মত দেখা যায় এবং আলু অল্প দিনের মধ্যেই পচে যায়।
৬. আলুর মোজাইক রোগ : আলুর মোজাইক রোগে পাতায় বিভিন্ন ধরনের ছিটে দাগ পড়ে, পাতা বিকৃত ও ছোট হয়। ভাইরাস এবং আলুর জাতের উপর নির্ভর করে লক্ষণ ভিন্নতর হয়। লতা ঝুলে পড়ে এবং পরবর্তীতে গাছ মারা যায়।
৭. আলুর হলদে রোগ : স্থানীয় জাতের আলুতে আলুর হলদে রোগ বেশি হয়। পাতা কুঁচকে যায় ও ছিটা দাগ দেখা যায়। দূর থেকে আক্রান্ত গাছ সহজেই চোখে পড়ে। আলু ছোট হয় বা একেবারেই হয় না।
৮. আলুর শুকনো পচা রোগ : ফিউজেরিয়াম প্রজাতির ছত্রাকের আক্রমণে আলুর শুকনো পচা রোগ হয়ে থাকে। আলুর গায়ে গভীর কালো দাগ পড়ে। আলুর ভিতরে গর্ত হয়ে যায়। প্রথম পচন যদিও ভিজা থাকে পরে তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। আক্রান্ত অংশে গোলাকার ভাঁজ এবং কখনো কখনো ঘোলাটে সাদা ছত্রাক জালিকা দেখা যায়।
৯. আলুর নরম পচা রোগ : আরউইনা কেরোটোফোরা ছত্রাকের আক্রমণে আলুর নরম পচা রোগ হয়ে থাকে। আক্রান্ত অংশের কোষ পচে যায়। পচা আলুতে এক ধরনের উগ্র গন্ধের সৃষ্টি হয়। চাপ দিলে আলু থেকে এক প্রকার দূষিত পানি বেরিয়ে আসে। আক্রান্ত অংশ ঘিয়ে রংয়ের ও নরম হয় যা সহজেই সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করা যায়।
১০. আলুর কাটুই পোকা : কাটুই পোকার কীড়া বেশ শক্তিশালী, ৪০-৫০ মি.মি. লম্বা। পোকার উপর পিঠ কালচে বাদামী বর্ণের, পার্শ্বদেশ কালো রেখাযুক্ত এবং বর্ণ ধূসর সবুজ। শরীর নরম ও তৈলাক্ত। কাটুই পোকার কীড়া চারা গাছ কেটে দেয় এবং আলুতে ছিদ্র করে আলু ফসলের ক্ষতি করে থাকে। পোকার কীড়া দিনের বেলা মাটির নীচে লুকিয়ে থাকে। আলু কাটা গাছ অনেক সময় কাটা গোড়ার পাশেই পড়ে থাকতে দেখা যায়।
১১. আলুর সুতলি পোকা : আলুর সুতলি পোকার মথ আকারে ছোট, ঝালরযুক্ত, সরু ডানাবিশিষ্ট ধূসর বাদামী হয়। পূর্ণাঙ্গ কীড়া সাদাটে বা হাল্কা গোলাপী বর্ণের এবং ১৫-২০ মি.মি. লম্বা হয়ে থাকে। কীড়া আলুর মধ্যে লম্বা সুড়ঙ্গ করে আলুর ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে বসতবাড়িতে সংরক্ষিত আলু এ পোকার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রতিকার: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণের অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময় পরিচর্যা:
১. আলু লাগানোর ৩০-৩৫ দিন পর গোড়ায় মাটি দেওয়া প্রয়োজন।
২. গাছ প্রায় ১৫ সে. মি. বড় হলে দুই সারির মাঝখানে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বা নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হবে।
৩. প্রতিবার সেচ দেওয়ার পর মাটি একটু শুকালে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হবে।
সাবধানতা:
১. জমিতে রস বেশি থাকলে বীজ আলু মাটির বেশি গভীরে রোপণ করা উচিত নয়।
২. মালচিং ব্যবহার করার ফলে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হতে পারে। তাই যথা সময়ে ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ফসল সংগ্রহ
১. বীজ বপনের ৩-৪ মাসের মধ্যেই আলু তোলার উপযুক্ত হয়।
২. গাছের রং হলুদ হলে বুঝতে হবে। আলু তোলার সময় হয়েছে।
৩. সম্পূর্ণ গাছ শুকালে আলু তুলতে হবে। আলু এমনভাবে তুলতে হবে যেন আলুর গায়ে আঘাত না লাগে।
প্রতি বিঘা জমি থেকে বছরে প্রায় ৫০-৬০ মণ আলু উৎপাদন করা সম্ভব।
কৃপ্র/ এম ইসলাম