কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক : বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদ উৎসব। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কোরবানির ঈদ। অন্যান্য উৎসবের চেয়ে এ উৎসব কিছুটা ব্যতিক্রম। মোটামুটি অন্য সব উৎসবের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, নতুন পোশাক কেনাকাটা। কিন্তু কোরবানির ঈদ মূলত পশুকেন্দ্রিক। এ ঈদে বিপুল সংখ্যক পশু জবাই করা হয় । তাই এ ঈদ উৎসব দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে।
কোরবানি ঈদের অর্থনীতি পশুকেন্দ্রিক হওয়ায় এর সাথে সম্পৃক্ত পশু উৎপাদন ও এর বাজার ব্যবস্থাপনা।
এক হিসাবে দেখা যায় যে, কোরবানীর ঈদে মোটামুটি এক কোটি পশু কোরবানি দেয়া হয়ে থাকে, যার মধ্যে গরুর পরিমাণ প্রায় ৬০ লাখ এবং বাকি ৪০ লাখ ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি। গড়ে একটি গরুর দাম ৫০ হাজার টাকা ধরলে এ সময়ে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার গরু কেনাবেচা হয়েছে। অন্যদিকে গড়ে ১০ হাজার টাকা মূল্য ধরে হিসাব করলে বাকি পশুর মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো। এবং এর সঙ্গে অন্যান্য ব্যয় যোগ করলে মোটামুটি এ ঈদে ৪ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
পশুর বাজার ব্যবস্থাপনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এ বিপুল পরিমাণ গবাদিপশুর চাহিদা মূলত দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো হচ্ছে। দু-তিন বছর আগে ভারত কর্তৃক গরু রফতানি নিষিদ্ধ করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট গরুর চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করা হতো (বৈধ ও অবৈধ পথে)। বর্তমানে ভারত থেকে আসা গরুর পরিমাণ ৫-১০ শতাংশে নেমে এসেছে বলে শোনা যায়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে ঈদের সময়কালীন বিপুল চাহিদা মেটানোর প্রচেষ্টাকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিআইডিএস, ঢাকার
সিনিয়র রিসার্চ ফেলোড. মনজুর হোসেন ।
তিনি মনে করেন, এতে করে এখানে আমদানি প্রতিস্থাপন নীতি গ্রহণের একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভালো দাম পাওয়ার কারণে খামারিরা গবাদিপশু উৎপাদনে আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি উৎসাহ বোধ করছে। ফলে এ খাতের দিকে আরো মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে বলে অভিমত দেন তিনি।
বিভিন্ন গবাদিপশু খামারি এবং কৃষকের ভাষ্য অনুযায়ী, এ খাতের উন্নয়নে সরকারের তরফ থেকে নানা পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ এবং অন্যান্য প্রণোদনা এ খাতে দেয়া যেতে পারে। এ খাতের উন্নয়নে তাই সহজ শর্তে ঋণ, আর্থিক সহায়তা, পশুখাদ্যে ভর্তুকি, পশু চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা আরো জোরালোভাবে নেয়া প্রয়োজন। প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি ও প্রণোদনার যেমন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তেমনি এ খাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থাপনাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কয়েক বছর ধরে পশু ও মাংসের দাম ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। মোটামুটি প্রতি বছর শতকরা ৩০-৪০ ভাগ হারে গবাদিপশুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তার সঙ্গে মাংসেরও। দাম বৃদ্ধিতে চাহিদা জোগানের ঘাটতির একটি প্রতিফলন রয়েছে। এটি দিয়ে এ বিষয়ও মোটামুটি পরিষ্কার যে, দেশীয় চাহিদার ঘাটতি মেটানোর জন্য আরো গবাদিপশু উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। দামের ক্ষেত্রে কোরবানির পশুর হাটের একটি আলাদা চিত্র রয়েছে। ঈদের কয়েক দিন আগের পশুর বাজার পর্যালোচনা করলে দামের ক্ষেত্রে একটি U আকৃতির ধারা লক্ষ করা যেতে পারে। যেমন— যদি ঈদের আগের এক সপ্তাহ বিবেচনা করা হয়, তাহলে প্রথম তিন-চারদিন দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকে, পরের দু-এক দিন নিম্নমুখী এবং শেষ দিন ঊর্ধ্বমুখী। এটি মোটামুটি সাধারণ চিত্র।
তবে এর ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। ঈদের আগের দিন এ দাম নিম্নমুখী হয়ে যাওয়া। ঈদের পশুর বাজারের দামের এ ওঠানামা কয়েক বছর পর্যালোচনা করলে এতে Cob-Web cycle পাওয়া যেতে পারে— এক বছর বৃদ্ধি, পরের বছর নিম্নগতি আবার তার পরের বছর বৃদ্ধি। ধরা যাক, এ বছর পশু ব্যবসায়ীরা যদি দাম কমে যাওয়ায় ভালো মূল্য না পেয়ে থাকেন, তাহলে তারা আগামী বছর পশু কম উত্পাদন করবেন বা বাজারে আনবেন। তাহলে চাহিদা জোগানের যে ঘাটতি তৈরি হবে, তাতে করে আগামী বছর পশুর মূল্য আবার ঊর্ধ্বমুখী হবে। বাজারের এ ভালো অবস্থা দেখে ব্যবসায়ীরা আবার যদি জোগান বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তার পরের বছর দামের আবার নিম্নমুখিতা দেখা যেতে পারে। এ ধরনের দামের ওঠানামা বাজারে দেখা গেলে তাকে অর্থনীতির ভাষায় Cob-Web cycle বলা হয়। দামের ক্ষেত্রে এ ধরনের প্যাটার্ন যদি দেখা যায়, তাহলে এ খাতের ওপর এ ধরনের মূল্যের প্রভাব কি, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। বাজার ব্যবস্থাপনার জন্যও এ ধরনের দামের প্যাটার্ন বোঝা দরকার। ঈদের পশুর বাজারের মূল্য এবং গবাদিপশু খাতের ওপর এর প্রভাব-সংক্রান্ত কোনো গবেষণা হয়েছে বলে জানা নেই যায়নি।
গবাদিপশু বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। একটি গবাদিপশুর উপজাত হিসেবে যা কিছু পাওয়া যায়, তার সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন— মাংস, চামড়া, নাড়িভুঁড়ি, শিং ইত্যাদির চাহিদা দেশের বাজার ছাড়াও বিদেশে রয়েছে। বাংলাদেশ দেশীয় চাহিদা মেটানোর পরও বিদেশে গত অর্থবছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করেছে। রফতানির ক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের পর চামড়া শিল্পের অবস্থান। আরো উৎসাহব্যঞ্জক খবর হলো, গত অর্থবছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার নাড়িভুঁড়ি, শিং ইত্যাদি রফতানি করা হয়েছে। এছাড়া বিদেশে হালাল মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাই রফতানি বহুমুখীকরণে লাইভস্টক খাতের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ড. মনজুর হোসেন বলেন, গবাদিপশু খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। রফতানির জন্য এটি একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত। ভারতের গরু রফতানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে এ খাতের জন্য শাপে বর হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গার্মেন্টস শিল্পের পরেই এ খাতের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এ খাতের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এ খাতের উন্নয়নের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তা মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন।
এ খাতের বাজার ব্যবস্থাপনা অবশ্যই প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। এজন্য বাজার তদারকির ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। পশু পালনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে। পশু মোটাতাজাকরণের নামে অগ্রহণযোগ্য ওষুধ ব্যবহার প্রতিরোধ করা এবং এ খাত সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। রোগবালাইয়ের মহামারী প্রতিরোধে আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং এর জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যথাযথ প্রস্তুতি থাকতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি। তাহলেই এ খাত অদূর ভবিষ্যতে আরেকটি পোশাক খাত হয়ে উঠতে পারবে।
কৃপ্র/ কে আহমেদ / এম ইসলাম