চাষা আলামীন জুয়েলঃ মাটি ছাড়া চাষাবাদ, হাইড্রোপনিকস / একোয়াপনিকস, পৃথিবীর তিন ভাগ পানি আর মাত্র এক ভাগ মাটি। এই এক ভাগ মাটিতেই মানুষের বসবাস ,চাষাবাদসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিশ্বের বিপুল জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা নিবারণে এই এক ভাগ মাটির উপরই আমরা নির্ভরশীল। এই বিষয়টি মাথায় রেখে নিরন্তর গবেষণা করে চলছেন আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা। কীভাবে সীমিত জমির উত্তম ব্যবহার করে ফসলের ফলন বাড়ানো যায় এ নিয়ে সারা বিশ্বে চলছে ব্যাপক গবেষণা। এ গবেষণায় সফলতা নেহায়েত কম নয়। এ গবেষণার ফলস্বরূপ পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ আজো পেট পুরে খেতে পারে। যদিও এখনো খাদ্য নিরাপত্তার বাইরে আছে শত কোটি মানুষ।
ধারাবাহিক গবেষণা করে কৃষি বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন একটি আধুনিক ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি, যে প্রযুক্তি ব্যবহার করলে চাষাবাদে প্রয়োজন হবে না ভূমি বা মাটির। মাটি ছাড়া ফসল আবাদ কীভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, হাইড্রোপনিক্স এমনই একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে পানি মাধ্যমে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। বাংলাদেশ জনবহুল একটি দেশ এবং প্রতি বছরই আবাদি জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর মতো হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে চাষ করে পুরো বছরব্যাপী বিভিন্ন শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
এই পদ্ধতিতে সারা বছরই সবজি ও ফল উৎপাদন করা সম্ভব এবং উৎপাদিত ফসলে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশে যেখানে চাষের জমি কম, সেখানে ঘরের ছাদে,বাড়ীর আঙিনায় বা বারান্দায় হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন সম্ভব।
এরই মধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাণিজ্যিকভাবে এ পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা মাটি ছাড়াই হাইড্রোপনিক্সের মাধ্যমে সবজি, ফুল ও ফল চাষে সফল হয়েছেন। এ পদ্ধতিতে সারা বছর পানিতে নিমজ্জিত থাকে এমন এলাকা বা বাড়ির বারান্দা, ছাদ ও উঠানে অধিক শস্য চাষাবাদ করে পারিবারিক চাহিদার অনেকাংশই পূরণ করা সম্ভব। হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে কৃষিবিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত টমেটো, বেগুন, শসা, মরিচ, শিম, খিরা, লেটুস পাতা, ক্যাপসিকাম, গাঁদা ফুল, চন্দ্রমলি্লকা, ফুলকপি, বাঁধা কপি, স্ট্রবেরি, অর্কিড ও ব্রোকলির মতো বেশ কিছু ফসলের চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। সাধারণত দুটি উপায়ে হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। ১. সঞ্চালন পদ্ধতি এবং ২. সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি।
১.সঞ্চালন পদ্ধতি — সঞ্চালন পদ্ধতিতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানগুলো যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি বড় পাত্র বা ট্যাঙ্কিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের সাহায্যে পাইপের মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। এ পদ্ধতি গ্যালভানাইজিং লোহার তৈরি ট্রে , একটি স্ট্যান্ডের ওপর স্থাপন করে প্লাস্টিক পাইপের সাহায্যে একটি ট্যাঙ্কির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ট্যাঙ্কি থেকে পাম্পের সাহায্যে রাসায়নিক দ্রব্যমিশ্রিত জলীয় দ্রবণ ট্রেতে সঞ্চালন করা হয়। ট্রের উপর ককশিটের মধ্যে গাছের প্রয়োজনীয় দূরত্ব অনুসারে গর্ত করতে হয়। উপযুক্ত বয়সের চারা ওই গর্তে স্থাপন করতে হয়। চারা রোপণের পর ট্যাঙ্কি থেকে ট্রের মধ্যে জলীয় দ্রবণ পাম্পের সাহায্যে প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ ঘণ্টা সঞ্চালিত করে গাছের অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। ট্রেতে কমপক্ষে ৬-৮ সেন্টিমিটার পানি সবসময় রাখতে হবে। সাধারণত প্রতি ১২-১৫ দিন অন্তর জলীয় দ্রবণ ট্রেতে যোগ করতে হবে। সাধারণত হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে উৎপাদনের জন্য পিএইচ মান ৫.৮-৬.৫-এর মধ্যে রাখতে হয়। যদি চঐ-এর মান ৭-এর উপরে হয় তবে আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, মলিবডেনাম সহ অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। এ অবস্থায় হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড বা ফসফরিক অ্যাসিড দিতে হয়। আবার পিএইচ ( PH )-এর মান ৫.৮-এর নিচে হলে তখন সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড প্রয়োগ করে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
২.সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি-— সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানগুলো পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়। তবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য কোনো পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। ফসলের প্রকারভেদে সাধারণত দু-তিনবার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করা হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সহজেই এ পদ্ধতি অনুসরণ করে স্টিলের ড্রাম,প্লাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদে বা খোলা জায়গায় সহজেই সবজি উৎপাদন করা যায়। চারা রোপণের আগে জলীয় দ্রবণ দ্বারা পাত্র এমনভাবে পূর্ণ করতে হবে, যাতে কর্কশিট ও জলীয় দ্রবণের মধ্যে ৫-৮ সেন্টিমিটার ফাঁকা জায়গা থাকে। হাইড্রোপনিক্স পদ্ধতিতে দ্রবণের আদর্শ তাপমাত্রা রক্ষা করতে হবে। সাধারণত দ্রবণের আদর্শ তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ও রোগমুক্ত চারা ব্যবহার করতে হবে।
হাইড্রোপনিকস পদ্ধতির জন্য রাসায়নিক দ্রব্যের পরিমাণ ও তৈরির প্রক্রিয়া একটু ভিন্ন রকম। প্রতি এক হাজার লিটার পানির জন্য পটাসিয়াম হাইড্রোজেন ফসফেট ২৭০ গ্রাম, পটাসিয়াম নাইট্রেট ৫৮০ গ্রাম, ক্যালসিয়াম নাইট্রেট ১ হাজার গ্রাম, ম্যাগানেসিয়াম সালফেট ৫১০ গ্রাম, ইডিটিএ আয়রণ ৮০ গ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ সালফেট ৬.১০ গ্রাম, বরিক এসিড ১.৮০ গ্রাম, কপার সালফেট ০.৪০ গ্রাম, অ্যামনিয়াম মলিবটেড ০.৩৮ গ্রাম, জিংক সালফেট ০.৪৪ গ্রাম হারে পানিতে মিশিয়ে খাদ্য দ্রবণ তৈরি করতে হবে।
একোয়াপনিকস—-
একোয়াপনিকস হচ্ছে হাইড্রোপনিকস ও একোয়াকালচারের সমন্বয়ে মাছ ও সবজির সমন্বিত চাষ ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিতে দুইটি প্রযুক্তিকে সমন্বয়ের মাধ্যমে মাটি ছাড়া সামান্য পানি ব্যবহার করে প্রচুর তাজা শাক সবজি ও মাছ পাওয়া যায়। এতে খুব বেশি জায়গার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া শাক-সবজি উত্পাদনের জন্য কোন প্রকার সার বা কীটনাশক এর দরকার নেই। এই পদ্ধতি খরা ও উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চলের জন্য খুব উপযোগী। কারণ এতে প্রায় ৯৭ শতাংশ পানি কম লাগে। মাছের ট্যাঙ্কের অ্যামোনিয়া সমৃদ্ধ পানি গাছের শিকড়ে অবস্থিত ডি-নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া ভেঙ্গে গাছের খাদ্য উপযোগী নাইট্রেটে পরিণত করে পানিকে দূষণ মুক্ত করে পুনরায় মাছের ট্যাঙ্কে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে।
এই পদ্ধতির উদ্ভাবক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ সালাম জানান, এই পদ্ধতিতে ফেলে দেওয়া পানির বোতল রি-সাইকেল করা যায়। বাঁশ বা কাঠ দিয়ে মাচা বানিয়ে জমির ব্যবহার কমিয়ে অল্প জায়গায় অধিক ফসল পাওয়া যায়। প্রতিটি বাড়িতে এই পদ্ধতির সাহয্যে ফসল ও মাছ উত্পাদন করে বাজার নির্ভরতা কমানো সম্ভব।
একোয়াপনিকস চাষাবাদ পদ্ধতি –—
এই পদ্ধতিতে মাছ ও সবজি চাষ করতে কোন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। ফলে উত্পাদিত মাছ ও সবজি খুবই স্বাস্থ্যসম্মত। বাসার ছাদের আয়তনের উপর নির্ভর যেকোন আকারের প্লাস্টিক ট্যাঙ্ক অথবা ড্রামের মধ্যে পানি দিয়ে সেখানে তেলাপিয়া, মাগুর, কই, পাঙ্গাসসহ বিভিন্ন দেশীয় জাতের মাছ চাষ করা যায়। সবজি চাষের জন্য একটি কাঠের আলনা বানিয়ে তাতে তিন সারিতে উল্টো করে একটির নিচে আরেকটি এভাবে দুইপাশে কাটা প্লাাস্টিকের বোতল বসিয়ে তাতে নুরি পাথর দিয়ে সবজির চারা লাগাতে হবে।
এবার মাছের ট্যাঙ্কের পানি বালতি করে উপরে তুলে সেখান থেকে সাইফন প্রক্রিয়ায় ফোটা ফোটা করে উপরের ওই চারা লাগানো বোতলে সরবরাহ করতে হবে। এই পানি পর্যায়ক্রমে উপর থেকে নিচে আরও দুটি বোতলের মধ্য দিয়ে গড়িয়ে একটি পাত্রে এসে জমা হয় যা পুনরায় মাছের ট্যাঙ্কে ব্যবহার করা হয়। মাছের ট্যাঙ্কের অ্যামোনিয়া সমৃদ্ধ পানি গাছের শিকড়ে অবস্থিত ডি-নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া ভেঙ্গে গাছের খাদ্য উপযোগী নাইট্রেটে পরিণত করে পানিকে দূষণ মুক্ত করে পুনরায় মাছের ট্যাঙ্কে ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। এ পদ্ধতিতে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শাকসবজি চাষ করা যায়। তবে টমেটো, শসা, করলা, শিম, ব্রকলি, পুদিনা, বেগুন, দেশি লেটুসসহ আমেরিকান লেটুস ফলন বেশ ভাল হয়। এই পদ্ধতিতে সবজি চাষের জন্য বাড়তি কোন প্রকার সার বা মাটির প্রয়োজন না পড়লেও মাছকে আলাদা খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
একটি জরিপে জানা গেছে, দেশে প্রতিদিন কমছে ২২০ হেক্টর চাষযোগ্য জমি। ফসলের মাঠে প্রতিনিয়ত বাড়ছে শিল্প আর আবাসন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসতভিটা তৈরি, অপরিকল্পিত চাষাবাদ, যোগাযোগের জন্য রাস্তা ও শিল্প-কলকারখানা স্থাপনের কারণে দেশে মাথাপিছু চাষযোগ্য জমির পরিমাণ সংকুচিত হচ্ছে। বর্ধিত জনসংখ্যার অব্যাহত খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে তাই শুধু আবাদি জমির ওপর নির্ভর করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের এমনি অবস্থায় প্রয়োজন অব্যবহৃত খালি জায়গা ও পতিত জমি শস্য চাষের আওতায় আনা। হাইড্রোপনিকস এবং একোয়াপনিকস চাষ পদ্ধতি এক্ষেত্রে সঠিকভাবে আরোপযোগ্য একটি কৌশল। ( সংগৃহীত ও সংকলিত )
আসুন আধুনিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজেকে ও দেশকে সমৃদ্ধ করি — সকলের জন্য শুভ কামনা — চাষা আলামীন জুয়েল
কৃপ্র/ এম ইসলাম