ড. সন্তোষ কুমার সরকার: পৃথিবীর সব স্তন্যপায়ী প্রজাতির মধ্যে শতকরা ৪২ ভাগ ইঁদুরজাতীয় প্রাণী। ইঁদুরজাতীয় প্রাণী রোডেন্টসিয়া (Rodentia) বর্গের ও মিউরিডি (Muridae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সারা পৃথিবীতে ২৭০০টির অধিক ইঁদুরজাতীয় প্রজাতি আছে। এ প্রাণীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের দাঁতের বিশেষ গঠন ও তার বিন্যাস। ১৬টি দাঁত থাকে। মাংসাশী ও প্রেষণ পূর্ব দাঁত নেই। তবে উভয় পাটিতে সামনে একজোড়া করে ছেদন দাঁত যা অত্যন্ত তীক্ষè ও ধারালো বাটালির মতো। ছেদন দাঁত গজানোর পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বাড়ে।
কাটাকাটি না করতে পারলে দাঁত বেড়ে চোয়াল দিয়ে বেড় হয়ে যায় এবং ইঁদুরের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। দাঁত ঠিক রাখার জন্য শক্ত জিনিস সর্বদা কাটাকাটি করে। ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, সজারু ইঁদুরজাতীয় প্রাণী। চিকা ইঁদুরজাতীয় প্রাণী নয়। ইঁদুর সর্বভুক, নিশাচর এবং স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম প্রাণী। এর উপকারী ও অপকারী উভয় ভূমিকা রয়েছে। তবে ক্ষতিকারক ভূমিকাই বেশি ।
ইঁদুরের আচরণের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যাবলি
যে কোনো পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে; খাদ্য, পানি ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা পেলে বাচ্চার সংখ্যা বাড়ানো ও কমানোর ক্ষমতা আছে; গর্ভধারণকাল প্রজাতিভেদে ১৮-২২ দিন, বাচ্চা প্রসবের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার গর্ভধারণ করে; সার্বক্ষণিক কৌতূহলি এবং অনুসন্ধানকারী স্বভাব থাকে। সবাইকে শত্রুভাবে; খাদ্য, পানি ও বাসস্থানের একটির অভাব হলে স্থান পরিবর্তন করে; ইঁদুরের স্মরণশক্তি (৬০ দিন মনে থাকে), ঘ্রাণশক্তি প্রখর, জিহ্বার স্বাদ মানুষের মতো (তিতা, মিষ্টি) এবং রঙ শনাক্ত করতে পারে না; ইঁদুরের খাদ্যভ্যাস প্রজাতি ও একই গোত্রভেদে ভিন্ন হয়; বাচ্চাদের অসুবিধা বা বিপদ অনুভব করলে নিজের বাচ্চা খেয়ে ফেলে; ইঁদুর সন্ধ্যা ও ভোর রাতে খাদ্য গ্রহণ ও সংগ্রহ এবং প্রজননে বেশি সক্রিয় হয়; খাদ্য, বাসস্থান ও পানির প্রাপ্যতার ওপর বংশবিস্তার নির্ভর করে।
ইঁদুরের পপুলেশন বেশি হওয়ার কারণ
যেখানে সারা বছর খাদ্য, বাসস্থান ও পানির নিশ্চয়তা প্রদানের স্থায়ী পরিবেশ রয়েছে সেখানে ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। যেমন শহরে গ্রামের চেয়ে ইঁদুরের সংখ্যা বেশি। শহরের ডাস্টবিন ইঁদুরকে সারা বছর খাদ্য ও বাসস্থানের স্থায়ী নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। ড্রেন ও ছিদ্র পাইপ ইঁদুরকে পানির নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। অনেক পতিত উঁচু ভূমি রয়েছে যেখানে বেশি জোয়ারের সময় ইঁদুর আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। এখানে রয়েছে নারিকেল, সুপারি, খেজুর, কলাগাছ, বরই, আম, মান্দারসহ ইত্যাদি গাছ যা ইঁদুর জোয়ারের সময় আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। হোগলাপাতা, কচুরিপানা, কচুগাছ, ঢোলকলমি রয়েছে যেখানে ইঁদুর আশ্রয় নিতে পারে। এছাড়া এর আগে এখানে কোনো রকম দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ধান ফসলের থোড় থেকে পাকা পর্যন্ত সময়ে প্রজনন করে। প্রজননের সময়ে একটি স্ত্রী ইঁদুর নিধন করতে পারলে ৩৫টি ইঁদুর নিধনের সমান ফল পাওয়া যাবে। গম, ভুট্টা, গোলআলু, নানা রকম ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের চাষ হয়, যা ইঁদুরের বংশবিস্তারের সহায়ক।
বিস্তৃতি (Distribution) : বাংলাদেশে নিচু এলাকায় জলাভূমিতে এদের উপস্থিতি আছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল এলাকায় যেমন মনপুরা দ্বীপ ও নিঝুম দ্বীপে এদের উপস্থিতি রয়েছে।
ইঁদুরের নিবাস : বর্ষা মৌসুমে মাঠের ফসল সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায়। এ সময় ইঁদুর উঁচু স্থানগুলো আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
১. ছোট-বড় অধিক উঁচু পতিত ভূমি ও ভিটাবাড়ি রয়েছে, সেখানে বর্ষাকালে আশ্রয় গ্রহণ করে। এসব পতিত উঁচু ভূমিতে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ৪০-৫০টির বেশি নতুন ইঁদুরের গর্ত পাওয়া গেছে।
২. মাঠে ও বসতবাড়ির পাশে হোগলাপাতার বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে;
৩. পুকুর ও খালে প্রচুর কচুরিপানা রয়েছে । এ সব স্থান ইঁদুরের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে;
৪. খালের পাড়, উঁচু রাস্তায় বর্ষার সময় গর্ত খুঁড়ে বাস করে থাকে;
৫. ঢোলকলমি, কচুগাছ, ছন ও অন্যান্য আগাছা প্রচুর পরিমাণে আছে যে স্থানগুলো ইঁদুর আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে;
৬. খামারের নারিকেল, সুপারি, আম, জাম, মান্দারগাছ, কলা, খেজুর গাছ, বনজ বৃক্ষগুলো ইঁদুর আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে;
৭. বন্যা হলে কচুরিপানা ও কাঠের সাথে এক স্থান হতে অন্য স্থানে ইঁদুরের বিস্তার ঘটে।
ইঁদুর দমনের প্রয়োজনীয়তা
১. বাংলাদেশে প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা ১২-১৫ লাখ মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য ক্ষতি করে;
২. প্রতিটি নারিকেল গাছের ১০-১২টি কচি নারিকেল প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা নষ্ট হয়। সুপারি ও শাকসবজি (গোলআলু), ডাল এবং তেল ফসলের অনেক ক্ষতি করে;
৩. রাস্তাঘাট, বাঁধ, সেচ নালা, বসতবাড়ি, দালানকোঠা এসব অবকাঠামোর গর্ত খননের ফলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয় এবং ১৫ শতাংশ সেচের পানির অপচয় হয়;
৪. ইঁদুর ৬০টির বেশি রোগের জীবাণু বহন ও বিস্তারকারী। এদের মাধমে অনেক ধরনের জুনোটিক রোগ যেমন- প্লেগ, অ্যাইরোসিস। এছাড়া নানা প্রকার চর্মরোগ, কৃমিরোগ, হানটাভাইরাস, মিউরিন টাইফাস, স্পটেড জ্বর, লেপটোস্পাইরোসিস, ইঁদুরের কামড়ানো জ্বর, জ-িস রোগের জীবাণু ইঁদুর দ্বারা বিস্তার ঘটে। এসব রোগের জীবাণু ইঁদুরের মলমূত্র, লোমের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে;
৫. ইঁদুর খাদ্যের বিষক্রিয়া ও পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে থাকে;
৬. হাঁস-মুরগির খামারে ইঁদুর মুরগির বাচ্চা ও খাদ্য খেয়ে ক্ষতি করে। এছাড়া হাঁস-মুরগির বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। বাংলাদেশে হাঁস-মুরগি খামারে ইঁদুর একটি প্রধান সমস্যা;
৭. ইঁদুরের উপস্থিতি স্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পদ এবং জিনিসপত্রের কমবেশি ক্ষতি হবেই। এজন্য ইঁদুরের উপস্থিতি দেখামাত্র মারার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
গর্ত পদ্ধতি (Burrow system) : গর্ত পদ্ধতিতে অনেক মুখ (৩-৫টি) থাকে। গর্ত পদ্ধতি সাধারণত খোলা রাখে এবং আবার অনেক বন্ধ করে রাখে। গর্তের মুখে ধানের শীষ বা খাদ্যের আবর্জনা রাখতে দেখা গেছে। গর্তে খাদ্য মজুদ করে না। একটি গবেষণার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাত্রিকালীন গতিবিধি প্রায় ২৫০ মিটার দূরে গিয়ে খাদ্য গ্রহণ করে ফেরত আসে। গর্ত থেকে অনেক দূর পর্যন্ত ইঁদুর চলাচলের রাস্তা সহজেই চোখে পড়ে। একটি গর্তে একত্রে পুরুষ ও স্ত্রী দুইটি ইঁদুর পাওয়া যায়।
শস্যের ক্ষতি বাংলাদেশে মাঠের কালো ইঁদুর সব প্রকার মাঠ ফসলের ও গুদামজাত শস্যের এক নম্বর ক্ষতিকারক প্রজতি। একটি ইঁদুর প্রতি রাতে ১০০-২০০টি কুশি কাটতে পারে। আমনধানের শতকরা ১০-১৫ ভাগ এবং গম ফসলের ১৫-২০ ভাগ বা তারও বেশি ক্ষতি করে থাকে। বাংলাদেশে গুদামজাত খাদ্যশস্যের ১২-১৫ শতাংশ বেশি মাঠের কালো ইঁদুর দ্বারা প্রতি বছর ক্ষতি হয়। বাংলাদেশে যখন ফসলের মাঠ পানিতে ডুবে যায় তখন বেড়িবাঁধ, রাস্তাঘাটে গর্ত করে আশ্রয় নিয়ে থাকে, এর ফলে কোটি কোটি টাকার রাস্তাঘাটের প্রতি বছর ক্ষতি হয়। সেচের নালায় গর্ত খননের ফলে ১০-১ শতাংশ পানির অপচয় হয়।
ইঁদুরের ক্ষয়ক্ষতি (Estimate rat damage)
ইঁদুর দ্বারা ফসল ও সম্পদের প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়। সব ফসল ও সম্পদের ক্ষতি সঠিকভাবে নির্ণয় করা বাস্তবে সম্ভব হয় না। পৃথিবীতে প্রতি বছর ইঁদুর দ্বারা যে পরিমাণ ক্ষতি হয় তার পরিমাণ ২৫টি গরিব দেশের মোট জিডিপির সমান হবে। ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে উপস্থিত ইঁদুরের সংখ্যার নিবিড়তার ওপর। বেশি ইঁদুরের উপস্থিতি মানে ফসল ও সম্পদের ক্ষতি বেড়ে যাবে। কারণ প্রতিটি ইঁদুর তার দেহের ওজনের ১০ শতাংশ খাদ্য প্রতিদিন গ্রহণ করে। সাধারণত বড় ইঁদুর প্রতিদিন ২৩-৫৮ গ্রাম এবং ছোট ইঁদুর ৩-৫ গ্রাম খেয়ে থাকে। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে ৭-৮ গুণ নষ্ট করে।
ইঁদুরের উপদ্রবের তীব্রতা তিন প্রকারের হয়। যথা-
ক. অল্প (Few) : ঘরে বা গুদামে ছোট অথবা বড় ইঁদুরের মল চোখে পড়বে। জীবন্ত ইঁদুর চোখে পড়বে না। ফসলের মাঠে ক্ষতির লক্ষণ বা ইঁদুরের গর্ত কদাচিৎ চোখে ধরা পড়বে।
খ. মধ্যম (Medium) : খাদ্যশস্যের মধ্যে ইঁদুরের মল, লোম পাওয়া যাবে। জিনিসে ক্ষতির চিহ্ন, জীবন্ত ইঁদুর দেখা যাবে এবং অল্প গর্ত দেখা যাবে। মাঠের ফসলে ইঁদুরের ক্ষতি ও গর্ত চোখে পড়বে।
গ. ব্যাপক (Severe) : অনেক মল যত্রতত্র দেখা যাবে। জীবন্ত ইঁদুর চোখে পড়বে। ইঁদুরের গর্ত দেখা যাবে । ইঁদুর দ্বারা ক্ষতির চিহ্ন দেখা যাবে।
পরিবেশবান্ধব ইঁদুর ব্যবস্থাপনা
ইঁদুরজাতীয় প্রাণী দমনের ক্ষেত্রে কোনো ম্যাজিক বুলেট নেই কারণ এদের ২০০ এর ওপরে ক্ষতিকারক প্রজাতি রয়েছে যাদের প্রত্যেকের আলাদা আচরণ, নিবাসন ও খাদ্যাভাসে ভিন্নতা বিদ্যমান। এজন্য একটি পদ্ধতি দ্বারা এদের দমন বা ক্ষতির পরিমাণ কমানো বাস্তবে সম্ভব নয়। প্রত্যেক ইঁদুরজাতীয় প্রজাতির ভিন্ন ইকোলজি রয়েছে । এ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করার সময় এ বিষয়টি সবসময় বিবেচনায় রাখতে হবে। ইঁদুর দমনের বিষয়টি সার প্রয়োগের মতো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। ফসলে অত্যধিক বেশি বা কম এবং অসময়ে সার প্রয়োগ করা হলে অর্থনৈতিক অপচয় ও পরিশ্রম বিফলে যায়। যে কোনো ইঁদুর দমনের ক্ষেত্রে একই রকম ঘটনা ঘটে থাকে।
ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ও কলাকৌশল
১. যে কোনো ফসল রোপণ বা বপনের সময় মাঠের ও আইলের ইঁদুর মারতে হবে;
২. জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জোয়ারের পানিতে সব মাঠ পানিতে ডুবে যায়। দিনে বেশি জোয়ারের সময় মাঠের ইঁদুরগুলো হোগলাপাতা, ঢোলকলমি, কচুরিপানার দলে, উঁচু ভূমি এবং গাছে আশ্রয় নিয়ে থাকে। এ সময় নৌকায় দলবেঁধে গিয়ে ওই সব স্থানের ইঁদুর টেঁটা ও লাঠি দিয়ে মারতে হবে। মাঠের বড় কালো ইঁদুর ডুব দিয়ে ও সাঁতার কেটে অনেক দূর যেতে পারে। এজন্য দলবেঁধে মাঠের ইঁদুরের সম্ভাব্য সব আশ্রয়স্থান ধ্বংস হবে। এতে পরবর্তীতে আমন ফসলে ইঁদুরের সংখ্যা ও ক্ষতি কম হবে;
৩. বর্ষাকালে সব রাস্তাঘাট, খালের পাড় ও উঁচু পতিত ভূমির ইঁদুর বিষটোপ প্রয়োগ করে মারতে হবে;
৪. ফসলের থোড় স্তরে ইঁদুরের প্রজনন কার্যকারিতা আরম্ভ হয়। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে ৯৫ শতাংশ বেশি স্ত্রী ইঁদুর গর্ভধারণ অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাই, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বেশি ইঁদুর মারা হলে পরে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকবে। এ সময় একটি স্ত্রী ইঁদুর মারতে পারলে পরবর্তীতে ৩৫টি ইঁদুর মারার সমান উপকার হবে।
গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর নিধন
উঁচু ভূমি ও রাস্তাঘাটের, খালের পাড়ে ইঁদুর গর্ত খুঁড়ে বের করা খুব কঠিন। যেখানে ইঁদুরের গর্তের পরিধি কম সেখানে গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর নিধন করা যায়। গর্ত খোঁড়ার সময় গর্তের চারদিক জাল দ্বারা ঘিরে নিলে ইঁদুর সহজে পালাতে পারে না।
ফাঁদ পেতে ইঁদুর দমন
নানা রকমের ফাঁদ বাজারের পাওয়া যায় যেমন জীবন্ত ইঁদুর ধরার ফাঁদ (তারের খাঁচা ফাঁদ ও কাঠে তৈরি ফাঁদ) এবং কেচিকল (Snap trap) এবং বাঁশের তৈরি ফাঁদ । স্থান কাল পাত্রভেদে এসব ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। ফাঁদে টোপ হিসেবে নারিকেল ও শুঁটকি মাছ ব্যবহার করা যেতে পারে।
গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুর নিধন : গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুর দমন করা বাস্তবে অনেক কঠিন। কারণ মাঠের বড় কালো ইঁদুর ও মাঠের কালো ইঁদুরের গর্তের দৈর্ঘ্য ও গভীরতা অনেক বেশি। ফসল কাটার পর গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর মারা যায়। এতে কোনো লাভ হয় না। প্রজাতি শনাক্তকরণের জন্য ফসল কাটার পর কিছুসংখ্যক গর্ত খুড়ে ইঁদুর সংগ্রহ করা যেতে পারে, যা ইঁদুর দমনের পরিকল্পনায় কাজে লাগবে।
গ্লুবোর্ড ব্যবহার : বাজারে তৈরি ইঁদুর নিধনের গ্লুবোর্ড পাওয়া যায়। বাসাবাড়ি ও অফিসে গ্লুবোর্ড ব্যবহার করে ছোট-বড় ইঁদুর নিধন করা যায়। ইঁদুর গ্লুবোর্ডে আটকা পড়ার পর তাড়াতাড়ি সরিয়ে ফেলতে হবে, কারণ অন্য ইঁদুর আটকানো ইঁদুরকে দেখতে পেলে গ্লুবোর্ডের কাছে যাবে না।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে ইঁদুর দমনের জন্য তীব্র বিষ বা একমাত্রা বিষ (যেমন-জিংক ফসফাইড), দীর্ঘস্থায়ী বিষ (যেমন-ল্যানির্যাট, ব্রমাপয়েন্ট, ক্লেরাট) এবং গ্যাসবড়ি (অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড) ব্যবহার হয়। এ বিষটোপ ব্যবহারের ক্ষেত্র সমস্যা হচ্ছে ইঁদুরের বিষটোপ লাজুকতা সমস্যা রয়েছে। এখানে টোপ হিসেবে শামুক, চিংড়ি, চাল বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব টোপের মধ্যে চিংড়ি মাছ ও শামুকের তৈরি বিষটোপ ইঁদুর বেশি খেয়েছে। এ বিষটোপ আমন ধানের থোড় আসার আগ পর্যন্ত প্রয়োগ করা হয়েছে।
গ্যাসবড়ি ইঁদুরের প্রজনন সময়ে ও ফসলের থোড় হতে পাকা স্তরে প্রতিটি নতুন গর্তে একটি গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে ইঁদুরের বাচ্চাসহ মারা যায় বলে ইঁদুরের পপুলেশন বাড়তে পারে না। গর্ত পদ্ধতিতে দমনে অনেক নতুন মুখ থাকে। সব গর্তের মুখ নরম বা কাদামাটি দিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। গ্যাসবড়ি প্রয়োগকৃত গর্তের মুখ পর দিন খোলা পেলে একইভাবে একটি গ্যাসবড়ি প্রয়োগ করতে হবে।
ধাতব প্রতিরোধক (Metal Proofed) : টিনের পাত লাগানোর আগে গাছকে ইঁদুরমুক্ত করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় মরা ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে হবে এবং অন্য গাছের সাথে লেগে থাকা ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে যাতে অন্য গাছ হতে ইঁদুর আসতে না পারে। নারিকেল, সুপারি গাছসহ ফল উৎপাদনকারী গাছের গোড়া গর্তে ২ মিটার ওপরে গাছের খাঁড়া কাণ্ডের চারদিকে ৫০ সেমি. প্রশস্ত টিনের পাত শক্তভাবে কাণ্ডের সাথে আটকিয়ে দিতে হবে। এতে ইঁদুর নিচ থেকে গাছের ওপরে উঠতে পারে না।
ইঁদুরভোজী প্রাণী : অনেক বন্যপ্রাণী (যেমন-বনবিড়াল, শিয়াল) এবং নিশাচর পাখি (যেমন- পেঁচা) ও সাপ (যেমন-গুঁইসাপ) এদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ইঁদুর। এদের বংশবিস্তারের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ইঁদুর নিধনে সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করতে হবে।
ইঁদুর দমন প্রযুক্তি পোকামাকড়, আগাছা বা অন্য বালাই থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইঁদুর দমন অভিযানের কর্মসূচি সফল করতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এক ফসলের পরিবর্তে বহু ফসলের চাষ হচ্ছে। তাই ইঁদুর সারা বছর প্রজনন করার সুযোগ পাচ্ছে। ইঁদুর দমনের জন্য লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনের কর্মসূচি রয়েছে, কিন্তু ইঁদুর নিধনের কোনো কর্মসূচি নেই। শহরের ইঁদুর দ্বারা পানি ও গর্ত খুঁড়ে ও ড্রেনে মাটি ফেলে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ ক্ষতি করছে তা কয়েক শত কোটির কম হবে না। শহরের পরিবেশের দূষণ ও রোগ জীবাণু বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে মশা নিধনের মতো ইঁদুর দমন কর্মসূচি নেয়া প্রয়োজন।
ড. সন্তোষ কুমার সরকার* * মুখ্য প্রশিক্ষক (অব.), ডিএই,