‘ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৬’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ ও শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন কৃষিভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটির বেশি এবং এটি বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ এবং সে সাথে একটি সম্ভাবনাময় বড় বাজার। আর সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ এর ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, সিডর, আইলা ইত্যাদি এবং সেই সাথে ফসলের বালাই ও ইঁদুরের আক্রমণের ফলে খাদ্য এবং অর্থকরী ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে অন্তরায়।
ইঁদুর নামক প্রাণীটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। অনেকেই এ প্রাণীটির ক্ষতিকর দিকটি গ্রাহ্য না করায় এর দমন ব্যবস্থার প্রতি সচেতনতা দেখান না। তবে যারা একবার প্রাণীটি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা এর দমন বা নিধনের ব্যাপারে সজাগ। প্রাণীটি ক্ষুদ্র হলেও এর ক্ষতিকর দিকটি বিশাল। ইঁদুরের বিচরণ ক্ষেত্র ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু করে বাড়ির শোয়ার ঘর পর্যন্ত সর্বত্র। আর তাই এদের ক্ষতির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। এরা মাঠের ফসল, গুদামজাত শস্য, ফল, শাকসবজি, সংরক্ষিত বীজ, কাপড়-চোপড়, কাগজ, লেপ-তোষক ইত্যাদি কাটাকুটি করে আমাদের প্রচুর ক্ষতি করে।
এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তাই নয়, এরা মানুষ ও পশুপাখির মধ্যে প্লেগ, জন্ডিস , টাইফয়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৬০ প্রকার রোগজীবাণুর বাহক ও বিস্তারকারী। একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে।
ইঁদুরের উভয় দন্তপাটিতে সামনে এক জোড়া করে খুব তীক্ষè দাঁত আছে, যা জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। আর এ সদা বর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা কাটাকুটি করতে থাকে। ফলে ইঁদুর যা খায় তার চেয়ে চার-পাঁচগুণ খাবার নষ্ট করে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি এত ভয়াবহ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪১০০টির মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৭০০টির মতো ইঁদুরের প্রজাতি পাওয়া গেছে। তবে এদের সবগুলোই মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। ২০টির মতো প্রজাতিকে ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রজাতিভেদে ইঁদুর ১৫-৪১ সেমি. লম্বা এবং ওজনে ১৫-৩২৬ গ্রাম হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে যেসব প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায় সেগুলো মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর, বাতি বা সোলাই ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, মাঠের নেংটি ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর এবং প্যাসিফিক ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নরওয়ে বা বাদামি ইঁদুর ঘরের ও গুদামজাত শস্যের ক্ষতি করে থাকে, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গুদামজাত শস্য, ফলজাতীয় ফসল এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি করে, বাতি বা সোলাই ইঁদুর ঘরের বইপত্র, কাপড়-চোপড় এবং শস্যদানা নষ্ট করে থাকে, মাঠের কালো ইঁদুর সব ধরনের মাঠ ফসল ও গুদামজাত ফসলের ক্ষতি করে থাকে, মাঠের বড় কালো ইঁদুর জলী আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে, মাঠের নেংটি ইঁদুর মাঠের দানা জাতীয় ফসল পাকার পর ফসলের ক্ষতি করে থাকে, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর ধান গম বার্লির ক্ষতি করে থাকে এবং প্যাসিফিক ইঁদুর ফলজ গাছ বিশেষ করে নারিকেল গাছের ক্ষতি করে থাকে।
ইঁদুর প্রাণীটি অতি ক্ষুদ্র হলে কি হবে, এদের ঘ্রাণ, আস্বাদন ও শ্রবণ শক্তি অতি প্রবল। ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খেয়ে ফার্মের মালিকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠের ফসল ছাড়াও সেচের নালায় গর্ত করার মাধ্যমে সেচের পানির ব্যাপক অপচয় ঘটায়। শুধু তাই নয় সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ এসব স্থানেও গর্ত খোঁড়ার ফলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে থাকে। সুতরাং প্রাণীটি ক্ষুদ্র হলেও এর ক্ষতিকর দিকটি বিশাল।
ইঁদুর নিধন অভিযান ২০১৬ এর উদ্দেশ্য
কৃষক, কৃষাণী, ছাত্রছাত্রী, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইপিএম/আইসিএম এসব ক্লাবের সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোসহ সর্বস্তরের জনগণকে ইঁদুর দমনে উদ্বুদ্ধ করা;
ইঁদুর দমনের লাগসই প্রযুক্তি কৃষি কর্মীদের মাধ্যমে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানো;
ঘরবাড়ি, দোকানপাট, শিল্পকারখানা ও হাঁস মুরগির খামার ইঁদুরমুক্ত রাখার জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
আমন ফসল ও অন্যান্য মাঠ ফসলে ইঁদুরের ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে রাখা;
গভীর ও অগভীর নলকূপের সেচের নালার ইঁদুর মেরে পানির অপচয় রোধ করা;
রাস্তাঘাট ও বাঁধের ইঁদুর নিধনের জন্য সর্বস্তরের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা;
ইঁদুরবাহিত রোগের বিস্তার রোধ করা এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা।
কর্মসূচির সময়
এক মাসব্যাপী ইঁদুর নিধন অভিযান সারা দেশে একযোগে পরিচালনা করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে ইঁদুর নিধন অভিযান, ২০১৬ এর উদ্বোধনের পর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে উদ্বোধন করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের দিনে বিগত অভিযানের জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ সংখ্যক ইঁদুর নিধনকারীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হবে। অঞ্চল, জেলা পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্য-উপজেলা চেয়ারম্যন- সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ-পৌরসভার চেয়ারম্যান- মেয়র অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি দ্বারা করাতে হবে। উপজেলা পর্যায়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য-উপজেলা চেয়ারম্যান-সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অথবা তার মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা করাতে হবে।
ইঁদুর দমন পদ্ধতি পোকা ও রোগবালাই দমন পদ্ধতির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ এখানে বিষটোপ ও ফাঁদ লাজুকতার সমস্যা রয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতি ও সঠিক স্থানে দমন পদ্ধতি গ্রহণ না করা হলে দমন ব্যবস্থা ততটা কার্যকর হয় না। একা ইঁদুর মারলে দমন ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ ইঁদুর সর্বদা খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য স্থান পরিবর্তন করে থাকে। এজন্য পাড়া-প্রতিবেশীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একই দিনে ও একই সময়ে ইঁদুর নিধন করা প্রয়োজন। ইঁদুর দমনের কলাকৌশল অধিক সংখ্যক কৃষকের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রত্যেক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার ব্লকের ৬০০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। এ বছর ১৫,০০০ কর্মসূচি পুস্তিকা ও ১০,০০০ পোস্টার মুদ্রণ করে অঞ্চল, জেলা ও উপজেলায় পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কর্মসূচি পুস্তিকায় ইঁদুর দমন প্রযুক্তি সংক্ষিপ্ত আকারে সংযোজিত করা হয়েছে। এছাড়া সরকার অনুমোদিত ব্রমাডিওলেন ও জিংক ফসফাইড গ্রুপর ইঁদুরনাশক (যেমন- ল্যানিরাট, ব্রমাপয়েন্ট ল্যানির্যাট, রেটক্স, জিংক ফসফাইড এসব) বিষটোপ যথেষ্ট পরিমাণে বালাইনাশক ডিলারের দোকানে মজুদ রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
ইঁদুর সমস্যা দীর্ঘদিনের এ সমস্যা আগে যেমন ছিল বর্তমানেও রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং অংশীদারিত্ব। ঘরবাড়ি, গুদাম, হাঁস-মুরগির খামার, অফিস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিনিয়ত ইঁদুরের উপস্থিতি যাচাই করে ইঁদুর নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইঁদুর নিধন অভিযানের সফলতা নির্ভর করে সর্বস্তরের জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ওপর। ইঁদুরকে একটা সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এর সমাধান সামাজিকভাবেই করতে হবে, যাতে ইঁদুর দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ধারায় কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে।
এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান
পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
কৃপ্র/ এম ইসলাম