মাহমুদ হোসেন ও ড. ইমানুন নবী খান।।
বাংলাদেশের কৃষিতে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গা-ভূমিহীন কৃষকদেরই জয়জয়কার। বাংলাদেশের মোট খাদ্যের ৪০ ভাগের জোগান দেয় শুধু বর্গাচাষিরা। কিন্তু কৃষির সব সংকটে এরা সংবেদনশীল অর্থাৎ জলবায়ুগত প্রতিকূলতা, উপকরণ সংকট, উৎপাদিত পণ্যের অস্বাভাবিক দরপতন, ইত্যাদি যে কোনো সমস্যায় এরাই সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন। যেহেতু বড় ও মাঝারি কৃষকরা খুব সহজেই সরকারি, বেসরকারি সেবা নাগালের মধ্যে পেতে পারে, তাই এসব প্রতিকূলতাও দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, বর্গা ও ভূমিহীন কৃষকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেবার নাগালের বাইরে থাকে। কাজেই যে কোনো সম্প্রসারণ সেবার প্রথমটা ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের কেন্দ্র করেই হওয়া উচিত। এদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা গেলে এসব সমস্যা মোকাবিলায় সমষ্টিগত উদ্যোগ হিসেবে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বোঝানো সহজ হয়।
একটি শক্তিশালী ও টেকসই কৃষক সংগঠন গড়ে উঠতে দুই ধরনের প্রেরণার প্রয়োজন হয়, বহিঃপ্রেরণা ও অন্তঃপ্রেরণা। বহিঃপ্রেরণা হলো কৃষক সংগঠন গড়ে তুলতে সরকারি-বেসরকারি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বা তাদের প্রকল্প কর্তৃক প্রেরণা। আর অন্তঃপ্রেরণা হলো সমশ্রেণীর কৃষকগণ একটি সাধারণ স্বার্থে (নিজেদের সমস্বার্থে) সদস্যদের নিজস্ব প্রেরণায় সংগঠিত হওয়া।
একটি টেকসই কৃষক সংগঠন গড়ে তুলতে বহিঃ ও অন্তঃ দুই ধরনের প্রেরণারই প্রয়োজন আছে। তবে সংগঠন গড়তে অন্তঃপ্রেরণার স্ফুরণ ঘটাতে, কৃষকদের নিজেদের সমস্যা সমাধানে নিজেরাই সংগঠিত হওয়ার জন্য উদ্যোগী হতে, সদস্যদের জন্য সরকারি সেবা সুনিশ্চিত করতে, উপকরণ সেবাসহ উৎপাদিত পণ্যের মূল্যের দরপতনে একাট্রা হয়ে কাজ করতে সরকারি-বেসরকারি সম্প্রসারণ সংস্থাগুলোর বহিঃপ্রেরণাকারী হিসেবে সহায়কের ভূমিকা পালন করার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
বহিঃপ্রেরণা
বাংলাদেশে প্রায় দুই লাখ ছোট বড় কৃষক সংগঠন, উৎপাদনকারী দল বা তাদের সমবায় রয়েছে (এফএও ২০১৩)। এদের প্রায় সবাই সরকারি বা বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্প সহায়তায় অর্থাৎ বহিঃপ্রেরণায় গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠন সরকারের উন্নয়ন কাজের অংশীদার হিসেবে প্রকল্প চিহ্নিত করা থেকে শুরু করে এর বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়নসহ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার পরিবর্তে প্রকল্পের বিভিন্ন প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, তথ্যবিস্তার, ঋণদান, ইত্যাদি কার্যাবলি সুসম্পন্ন করার জন্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে প্রকল্পের কোনো কাজেই তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না তাই সংগঠনের সদস্যরা সংগঠনের প্রতি তাদের মালিকানা অনুভব করে না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রবণতাটা এমন যখন কোনো একটা প্রকল্পে কৃষক সংগঠন গড়ার প্রয়োজন হয়, মাঠ সম্প্রসারণ কর্মীগণ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে তার পরিচিত কৃষকদের ডেকে বলেন ২০-২৫ জনের একটা করে সমিতি তৈরি করে নাম-ঠিকানাসহ তার সঙ্গে অথবা প্রকল্প অফিসে যোগাযোগ করার জন্য। আর এতেই ঘটে বিপত্তি! এভাবে গড়া সংগঠনে সমশ্রেণীর কৃষক থাকে না ফলে বড় কৃষকরাই প্রকল্পের সুবিধা বেশি ভোগ করে। আবার কোনো কোনো প্রকল্প যদিও ভিত্তি জরিপ করে সমশ্রেণীর কৃষক চিহ্নিত করে থাকে তথাপিও কৃষকরা জানে যে তাদের সংগঠনে আসতে হবে প্রকল্প থেকে প্রদর্শনী, প্রশিক্ষণ, উপকরণ, ইত্যাদি সুবিধা পাওয়ার জন্য।
আবার এসব প্রকল্পে যদি ব্যয়বহুল কোনো উপকরণ (যেমন- কৃষি যন্ত্রপাতি বা থোক অনুদান) বিতরণের সুযোগ থাকে তাহলে আরেক বিপত্তি! সেটাও সংগঠনের সবার মালিকানায় বিতরণ না হয়ে নামে বেনামে বড় কৃষকদের কুক্ষিগত হয়। তাই বহিঃপ্রেরণায় কৃষক সংগঠন গড়তে এসব পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে সংগঠনগুলো টেকসই হয় না এবং প্রকল্প শেষ হলেই এদের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়ে।
বহিঃপ্রেরণায় গড়লেও সরকারি সংস্থার মাঠ সম্প্রসারণ কর্মীগণ যদি প্রকল্পের শুরুতেই সমশ্রেণীর ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-বর্গা কৃষকদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে নিজেদের সাধারণ সমস্যাগুলোকে সমাধানের জন্য কেন সংগঠিত হওয়া প্রয়োজন, সংগঠিত হওয়ার সুবিধা, সুশাসন ও স্বচ্ছতার চর্চা বজায় রেখে সংগঠনকে টেকসই করে তোলার ব্যাপারে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করতেন তাহলে বাংলাদেশের কৃষক সংগঠনগুলোর চেহারাটা অন্যরকম হতো। একটি টেকসই সংগঠন গড়ে তোলার জন্য যেসব আদর্শ নিয়মনীতি রয়েছে সেগুলোর মাপকাঠিতে যদি কৃষক সংগঠনগুলোর মাঝে প্রকল্প সুবিধা বণ্টন করা যেত তবে সরকারি-প্রকল্প সেবা অনুকূলে পাওয়ার জন্য কৃষক সংগঠনগুলোর মাঝে একটা উদ্দীপনার সৃষ্টি হতো।
এভাবে কৃষক সংগঠন গড়তে বহিঃপ্রেরণাকারী হিসেবে সম্প্রসারণ সংস্থাসমূহ নিমোক্ত কয়েকটি মৌলিক ধাপে কাজ করতে পারে-
ধাপ ১ : অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে সমশ্রেণীর কৃষক চিহ্নিত করা : বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-বর্গা কৃষক, এলাকার রাজনৈতিক নেতা, অভিজাত ব্যক্তিবর্গ, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-ভূমিহীন কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে এদের সংগঠিত করা। বিষয়টি সম্পর্কে বড় কৃষক বা রাজনৈতিক নেতাদের স্পষ্ট ধারণা দিলে তারা এতে নাক গলাবেন না বরঞ্চ সহায়ককে সহযোগিতা করার আশ্বাসও দিতে পারেন। যদি প্রকল্প কর্তৃক কোনো উপকরণ বিতরণের সুযোগ থাকে তবে বড় ও অভিজাতদের সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে যে এসব উপকরণ ব্যক্তি মালিকানায় দেয়া হবে না বরং যদি সংগঠন আদর্শ নিয়মনীতি মেনে চলে তবেই সামাজিক মালিকানায় দেয়া হবে অর্থাৎ সংগঠনের সদস্য ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-ভূমিহীন কৃষকদের সবার মালিকানায় সেটা বিতরণ করা হবে।
ধাপ ২ : সংগঠনের মূলনীতি : প্রকল্প শুরুতেই সমশ্রেণীর কৃষকদের একটি আদর্শ সংগঠন গড়ে তোলার মূলনীতিগুলো যেমন- সর্বজনস্বীকৃত নেতৃত্ব, সমশ্রেণীর কৃষকদের মজবুত সদস্য ভিত্তি, নতুন নেতৃত্ব সৃজনে ‘এক সদস্য এক ভোট’ নীতি, স্বচ্ছ হিসাব ব্যবস্থাপনা, দলীয় সদস্য সঞ্চয় ও চাহিদাভিত্তিক ব্যবসায়িক সেবা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে।
ধাপ ৩ : মানদ- নির্ধারণ : অতঃপর এসব নীতির ওপর ভিত্তি করে সংগঠনগুলোর একটা মানদ- নির্ণয় করে সর্বোচ্চ মান প্রাপ্ত সংগঠনগুলোকে সম্প্রসারণ সেবা প্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ধাপ ৪ : প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্প্রসারণ সেবা প্রদানের কৌশল : প্রকল্প বা সম্প্রসারণ সংস্থা কর্তৃক সর্বোচ্চ মানপ্রাপ্ত সংগঠনগুলোকে সেবা হস্তান্তরের বেলায় অংশগ্রহণমূলকভাবে সব সদস্যের সম্মতিতে কৌশল নির্ধারণ উচিত। এতে সদস্যদের ভেতর ক্ষোভ-বিক্ষোভের লাঘব ঘটে এবং সদস্যরা একযোগে কাজ করতে পারে, সংগঠনের প্রতি বন্ধন দৃঢ় হয়। ধরুন কোনো প্রকল্প হতে একটি সংগঠনকে পাওয়ার টিলার দেয়া হবে; তখন অবশ্যই একটি অংশীদারমূলক চুক্তিনামা করে সংগঠনের সবার মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা যায়। আবার প্রদর্শনী স্থাপন বা প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের বেলায় সংগঠনের সব সদস্যর মতামতে উপযুক্ত কৃষক-কৃষাণী সদস্যকে নির্বাচন করা উচিত।
ধাপ ৫ : সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংগঠিত কৃষকদের অংশগ্রহণ : প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্প্রসারণ সেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রকল্পের সব কাজে সর্বোচ্চ মানপ্রাপ্ত সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারলে সংগঠনের সদস্যরা সম্মানিত হয়, অভ্যন্তরীণভাবে অনুপ্রাণিত হয় এবং সংগঠনের প্রতি অনুগত হয়। সংগঠিত কৃষকদের স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন কমিটি যেমন- ইউনিয়ন ও উপজেলা কৃষি কমিটি, উপজেলা সেচ কমিটি, উপজেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি, খাস জমি বন্দোবস্ত কমিটি, ইত্যাদিতেও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ রাখা উচিত।
অন্তঃপ্রেরণা
সদস্যদের ভেতরের তাড়নায় সাধারণ স্বার্থে গড়ে উঠা কৃষক সংগঠন। ক্ষুদ্র-প্রান্তিক-ভূমিহীন-বর্গা কৃষকরা যখন একটি নির্দিষ্ট সমস্যা যেটি সবাইকে সমভাবে প্রভাবিত করে তা সমাধানে কোনো রকম বহিঃপ্রেরণা ছাড়াই সংগঠিত হয়। কৃষিতে বিদ্যমান কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য এসব ক্ষুদ্র কৃষকরা নিজেরা এক হয়ে অভ্যন্তরীণ অনুপ্রেরণায় সংগঠন গড়ে তোলেছে, বাংলাদেশে এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম। তবে মজার বিষয় হচ্ছে নির্দিষ্ট কোনো একটি এলাকা যেটি একটি নির্দিষ্ট ফসল বা পণ্যের জন্য বিখ্যাত, সেখানেই নিজে নিজে গড়ে ওঠা কিছু সংগঠন পাওয়া গেছে যারা মূলত গড়ে উঠেছে ভরা মৌসুমে উৎপাদিত পণ্যের অস্বাভাবিক দরপতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে একযোগে কাজ করার প্রয়াসে। যেমন- মধুপুরে আনারস ক্লাস্টারে ইদিলপুর আনারস চাষি সমবায় সমিতি, চরফ্যাশনে শশা ক্লাস্টারে আদর্শ চাষি উন্নয়ন সংস্থা, যশোরে গদখালিতে ফুল ক্লাস্টারে গদখালি ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, চুয়াডাঙ্গায় নবগঙ্গা পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি, কক্সবাজারে নাজিরেরটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, ইত্যাদি উৎপাদনকারী দলসমূহ। তবে অন্তঃপ্রেরণায় গড়ে উঠলেও এসব দলে সুশাসন, নেতৃত্বের মাঝে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক, ন্যাশনাল টিম লিডার, আইএপিপি-টিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ** প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, আইএপিপি-টিএ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা/ কৃপ্র/এম ইসলাম