‘ইউক্যালিপটাস ও ইপিলইপিল গাছ পরিবেশ ও প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলে’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ দ্রুত বর্ধনশীল অজুহাতে প্রতিবেশ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ইউক্যালিপটাস, মেনজিয়াম ও ইপিলইপিল গাছের প্রচলন হয় দেশে। আর এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে খোদ বন অধিদপ্তর। তবে দেরিতে হলেও ক্ষতিকর এসব গাছ লাগানো থেকে সরে আসছে অধিদপ্তর। আগামী বছরেই ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার ও ৮ হাজার ৭০০ হেক্টর জমিতে ব্লক ও স্ট্রিপ বাগান তৈরি করবে সংস্থাটি। আর বনায়নের এ উদ্যোগে দেশীয় দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির চারা রোপণের বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়।
বিদেশী প্রজাতির অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল ইউক্যালিপটাস ও ইপিলইপিল গাছ পরিবেশ ও প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মাটির উর্বরা শক্তি নষ্ট করায় পরিবেশবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে এসব গাছ রোপণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু এত দিন খোদ বন অধিদপ্তরই বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। বরং বিভিন্ন বনায়ন কর্মসূচিতেই দেখা গেছে এসব গাছ রোপণের আধিক্য। অবশেষে এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে বন অধিদপ্তর। বিভিন্ন বনায়ন কর্মসূচির আওতায় বিদেশী এসব গাছের বদলে দেশীয় দ্রুত বর্ধনশীল ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে বন অধিদপ্তর। এরই মধ্যে তিনটি পৃথক কর্মসূচির আওতায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, ইউক্যালিপটাস ও ইপিলইপিলের মতো বিদেশী দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির গাছ মাটির ৫০-৬০ ফুট নিচ পর্যন্ত পানি শোষণ করে তা বাতাসে ছেড়ে দেয়। ফলে পানিশূন্যতা দেখা দেয় মাটিতে। এছাড়া এসব বিদেশী গাছের শিকড় বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে থাকে। এতে এসব গাছের আশপাশে ধানসহ অন্য যেকোনো গাছের টেকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ কারণে শুরু থেকেই এসব গাছ লাগিয়ে বনায়নের বিরুদ্ধে ছিলেন পরিবেশবাদীরা।
তাদের মতে, বিদেশী প্রজাতির এসব গাছ সংশ্লিষ্ট দেশের পরিবেশ ও আবহাওয়ায় উপযুক্ত হতে পারে। কিন্তু উচ্চ বর্ধনশীল এসব গাছ আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। বিদেশী গাছ দিয়ে বনায়ন হয়েছে— এমন জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে সেখানে কীটপতঙ্গ, এমনকি প্রজাপতির সংখ্যাও তুলনামূলক কম। অথচ দেশীয় উদ্ভিদ ও অন্যান্য ফসলের পরাগায়নের জন্য প্রজাপতি অবশ্যম্ভাবী। এ কারণে বিদেশী প্রজাতির এ গাছগুলোর বিস্তার জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি।
প্রকৃতিবিদ অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা বণিক বার্তাকে বলেন, ইউক্যালিপটাস, মেনজিয়াম, ইপিলইপিলসহ বেশকিছু বিদেশী প্রজাতির গাছ আমাদের দেশের আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। এসব কথা আমরা অনেক দিন ধরেই বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের বলে আসছি। আমাদের দেশেই দ্রুত বর্ধনশীল গাছের প্রজাতি রয়েছে। এসব গাছ আমাদের পরিবেশের জন্য উপযুক্তও। অথচ বন বিভাগ আমাদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশী প্রজাতির গাছ লাগিয়েছে। এখন নিজেরাই বুঝতে পারছে যে, এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে। গর্জন, গামারিসহ নানা দেশীয় প্রজাতির গাছ দিয়ে বনায়ন কর্মসূচি পালন করা হলে তা আমাদের দেশের পরিবেশের জন্যই ইতিবাচক হবে।
দেরিতে হলেও ইউক্যালিপটাস ও ইপিলইপিলের মতো দ্রুত বর্ধনশীল বিদেশী গাছ দিয়ে বনায়ন কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে বন অধিদপ্তর। এরই মধ্যে দেশীয় ফলদ ও ঔষধি গাছকে প্রাধান্য দিয়ে তিনটি পৃথক বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছে অধিদপ্তর। বিগত তিন অর্থবছরে বাস্তবায়িত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি এবং রাজস্ব বাজেটের অধীনে ২৯ হাজার ৪৪৬ হেক্টর ব্লক বাগান ও ৫ হাজার ৭৩৫ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান করছে বনবিভাগ। এর মধ্যে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের অধীনে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোর আওতায় ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১২ হাজার ৯৬৯ হেক্টর ব্লক বাগান, ৮৯৮ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান করা হয়েছে। একই সময়ে সরকারি সম্পদে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বন অধিদপ্তর ৬২ হাজার ৩৭৬ জনকে সামাজিক বনায়নে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। পাশাপাশি ৩ হাজার ৪৭৩ হেক্টর ব্লক বাগান ও ১ হাজার ৩৪৭ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান কর্তন করেছে। আর এসব ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দেশীয় উচ্চ বর্ধনশীল ফলদ ও ঔষধি গাছের প্রজাতিকে।
এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুছ আলী বলেন, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গাছের কোনো বিকল্প নেই। বিদেশী গাছের আশপাশে অন্য কোনো গাছ জন্মাতে পারে না। এ গাছ আশপাশের এলাকার মাটি শুকিয়ে ফেলে। ফলে জমির উর্বরা শক্তি কমে যায়। এজন্য ক্ষতিকর এসব গাছ লাগানোয় সম্পূর্ণ নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির সঠিক গাছ লাগানোর মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সরকার কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, বনভূমির সংকোচন হার হ্রাস এবং বন সম্প্রসারণে অংশীদারিত্বমূলক ব্লক বাগান ও স্ট্রিপ বাগান ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণ করা হবে। এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূলীয় চর বাগান ও ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজনের ফলে সামগ্রিকভাবে তা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া এ প্রক্রিয়ায় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণও ভালোভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।
জানা গেছে, উপকূলীয় এলাকা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা ও গোপালগঞ্জ জেলায় স্ট্রিপ বনায়ন কার্যক্রমকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বেড়িবাঁধ এবং সড়ক ও জনপদের বিভিন্ন রাস্তায় বনায়নের জন্য বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ি তিন জেলাকেও এ বনায়নের আওতায় আনা হবে। এর মাধ্যমে ভূমির ক্ষয়রোধ, বনভূমির ক্ষয়রোধ, নতুন জেগে ওঠা চরভূমির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি, ভূমির গুণগতমান বৃদ্ধি, পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জানমাল রক্ষা করা যাবে বলে আশা করছে বন অধিদপ্তর।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/ এম ইসলাম