কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ যত্রতত্রভাবে ভূমির ব্যবহার বন্ধে প্রণয়ন হচ্ছে ভূমি সুরক্ষা আইন। যার মাধ্যমে কৃষি জমির সুরক্ষা এবং ভূমির অবাধ ব্যবহার কমে আসবে মনে করছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা। এগুলো ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১৬’ দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে। আইনে বলা হয়েছে, ভূমি জোনিংয়ের কার্যকরী ও প্রয়োজনীয় ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভূমির সর্বোত্তম ও যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এই আইন লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ তিন বছরের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অর্থদণ্ড- অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
জানতে চাইলে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশে ভূমি বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তবে সমুদ্র ও নদী থেকে কিছু জমি বাড়ছে। ভূমি সমস্যা এদেশে নতুন নয়; বহুবছর ধরে এটা চলে আসছে। ঔপনিবেশিক সরকার আমলেও সমস্যা ছিল। এ কারণে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। তাই অযৌকিক্তকভাবে যাতে কৃষি জমির ব্যবহার না হয় সেজন্য এই আইন করা হচ্ছে।
জানা গেছে, কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ভূমি ব্যবহার বাস্তবায়ন কমিটির সভা গত মাসে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর এ খসড়ার উপরে আগস্টে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগের মতামত ও পরামর্শ নেয়া হয়। এ আইনের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনও মতামত দিয়েছে।
আইন প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ বাংলাদেশ। একলাখ চুয়ালি্লশ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত রাষ্ট্রে ১৬ কোটির বেশি মানুষ। ফলে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে নিয়ত কমছে কৃষিজমি। চাপ বাড়ছে ভূমির ওপরে। এগুলোর প্রভাবে প্রতিনিয়তই ভূমির প্রকৃতি ও ভূমির শ্রেণিগত ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটছে।
পাশাপাশি দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমি, বনভূমি, টিলা. পাহাড় ও জলাশয়/জলমহাল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন পড়ছে হুমকির মুখে। মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পরিবেশও। এই অনুকূল পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অপরিকল্পিত বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা বা রাস্তাঘাট নির্মাণ বন্ধে ভূমির শ্রেণি বা প্রকৃতি ধরে রাখা এখন চ্যালেঞ্জ। এমনকি পরিবেশ ও খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষিজমি ও কৃষিপ্রযুক্তির প্রায়োগিক সুবিধার সুরক্ষা জরুরি। একই সঙ্গে ভূমির পরিকল্পিত ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা সমীচীন।
এদিকে, আইনের ৬ ধারায় বলা আছে, ‘কৃষিজমি’ বলতে ফসলি জমি, বনভূমি, গোচারণ ভূমি, খড় উৎপাদনের ভূমি, পশুখাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ব্যবহৃত ভূমি, চা বাগান, ব্যক্তিগত বনভূমি, ফলদ উদ্ভিদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত ভূমিকে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও ফলমূল, শাকসবজি, মসলা, ডাল, তেলজাতীয় খাদ্য, ঔষধি, সুগন্ধি, প্রাকৃতিক রং, বাঁশ, বেত, হোগলা-গোলপাতা ও অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হয়; এমন ভূমি, মাছ চাষের পাশাপাশি ফসল উৎপাদনের জলাশয়- কৃষিজমির অন্তর্ভুক্ত হবে।
আইনের ৪(১) ধারাতে বলা হয়েছে, আইনের মাধ্যমে কৃষিজমি সুরক্ষা করতে হবে এবং কোনোভাবেই তার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কৃষিজমি নষ্ট করে আবাসন, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনুর্বর, অকৃষি জমিতে আবাসন, বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। যে কোনো শিল্প-কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস ভবন, বাসস্থান এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মণের ক্ষেত্রে ভূমির ঊর্ধ্বমুখী ব্যবহারকে প্রাধান্য দিতে হবে। এজন্য থাকবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।
কৃষিজমি যে কেউ ক্রয়-বিক্রয় করতে পারলেও তা আবশ্যিকভাবে শুধু কৃষিকাজেই ব্যবহার করতে হবে। একাধিক ফসলি জমি সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনো অবস্থাতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না। কৃষিজমিতে চিংড়িমহল হিসেবে ঘোষণা করাও যাবে না।
কৃষিজমি ছাড়া অন্য জমির সুরক্ষা: ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যেসব জমি বনভূমি, টিলা-পাহাড় শ্রেণির, জলাভূমি, চা বাগান, ফলের বাগান, রাবার বাগান ও বিশেষ ধরনের বাগান হিসেবে পরিচিত; তাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ভূ-প্রকৃতিগত কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপচয় রোধে জমির অধিগ্রহণ নূ্যনতম পর্যায়ে রাখতে হবে এবং অধিগ্রহণকৃত জমির অপব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। অধিগ্রহণকৃত জমি বেদখল থাকলে তা অনুসন্ধান করে মুক্ত করতে হবে।
ভূমির অপচয় রোধে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে একই এলাকায় নিবিড়ভাবে স্থান সংকুলানের ওপর জোর দেয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে। কৃষিজমিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ফসল ( যেমন-তামাক) উৎপাদনও করা যাবে না।
জলাভূমির সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধার: খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ও ঝিলসহ যে কোনো ধরনের সায়রাতমহালের বা জলাভূমির কোনো শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। হাটবাজার, বালুমহাল, পাথরমহাল, বাগান মহাল, প্রত্নতাত্তি্বক এলাকারও শ্রেণি পরিবর্তন ঘটানো যাবে না।
ভূমি অধিগ্রহণ : অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয় যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের বিধান অনুসরণ করা হবে। নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণ করার আগে অধিগ্রহণকৃত জমি পূর্ণর্ ব্যবহার না করে অধিগ্রহণ করা যাবে না।
ভূমি জোনিং: সরকার ভূমির বিদ্যমান বহুমাত্রিক ব্যবহার, প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতা এবং গুণাগুণ অনুযায়ী কৃষি, মৎস্য, পশুসম্পদ, বন, চিংড়ি চাষ, শিল্পাঞ্চল, পর্যটন, প্রত্নতাত্তি্বক এলাকা এবং প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য এলাকার ক্ষেত্রে ভূমির পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারাদেশে পর্যায়ক্রমে ভূমি জোনিংয়ের ব্যবস্থা করবে।
এর মানচিত্র : সব পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়নে ভূমির ব্যবহার ও গুণাগুণভিত্তিক এলাকা চিহ্নিত করে ভূমি জোনিং মানচিত্র প্রস্তুত করতে হবে। অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এবং পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মানচিত্র অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে প্রস্তুত করার কথা বলা আছে। এছাড়া দেশের সব জমির জন্য ভূমি জোনিং করতে হবে। ভূমি জোনিং মানচিত্র মৌজা বা ইউনিয়ন, ওয়ার্ডভিত্তিক করতে হবে। ভূমির বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পর্কিত তথ্য ভূমি জোনিং মানচিত্রে উল্লেখ থাকবে। সকল ভূমি জোনিং মানচিত্র রঙিনভাবে মুদ্রিত হবে এবং প্রতিবেদনসহ ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত রাখা হবে।
সুত্রঃ jaijaidinbd.com/ কৃপ্র/এম ইসলাম