এস এম মুকুল: বাংলাদেশের রপ্তানি তালিকায় নতুন আরেক সম্ভাবনার নাম কুমির। বিশ্ববাজারে চাহিদার আলোকে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে বাণিজ্যিক কুমির চাষ। কুমির এখন নতুন সম্ভাবনাময় অপ্রচলিত রপ্তানিপণ্য হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত দেশের একমাত্র কুমির খামার থেকে কুমির রপ্তানি করে বছরে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব। সরকার এবং বন বিভাগের সহায়তা পেলে এ খাতে দেশে নতুন ও তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০২১ সাল নাগাদ শুধু কুমির রপ্তানি খাত থেকেই ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব।
চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কুমিরের মাংসেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এসব দেশে প্রতি কেজি প্রক্রিয়াজাত কুমিরের মাংস প্রায় ১৭৫ মার্কিন ডলার থেকে ২০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। কুমিরের কিছুই ফেলনা নয়। কুমিরের পাকা চামড়ার চাহিদা রয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ উন্নত বিশ্বে। কুমিরের চামড়ার ব্যাগ আন্তর্জাতিক বাজারে কম-বেশি প্রায় ৫০ হাজার মার্কিন ডলারে বিক্রি হচ্ছে। কুমিরের হাড় দিয়ে প্যারিসে তৈরি হচ্ছে দামি সুগন্ধি। দাঁত থেকে তৈরি হচ্ছে মূল্যবান গয়না। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত ২০০৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ৫০ হাজার কুমির হাত বদল হয়েছে। ২০০৮ সালে বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে কুমির রপ্তানির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার।
বর্তমানে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে কুমিরের চাষ হচ্ছে। একই সঙ্গে চীন, থাইল্যান্ড, জাপান, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কুমিরের মাংসেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চীন, জাপান, তাইওয়ান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যমানের কুমিরের গোশতের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, ব্যাংকক, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, পাপুয়া নিউগিনি, ইন্দোনেশিয়া, চীনসহ প্রায় অর্ধশত দেশে কুমিরের বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। ভালো খবর হচ্ছে_ এশিয়ার মধ্যে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষ শুরু করে। এ ছাড়া ৫০টি কুমির দিয়ে গত বছর আকিজ গ্রুপ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে আরও একটি কুমিরের বাণিজ্যিক খামার শুরু করেছে। ওই কুমিরগুলোও মালয়েশিয়ার সারওয়াত খামার থেকে আনা হয়েছে।
ভালুকায় কুমিরের খামারঃ ভালুকা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাতিবেড় গ্রামে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড নামে ১৩.৫৬ একর জমি ক্রয় করে ২০০৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ৭৪টি কুমির দিয়ে একটি বাণিজ্যিক কুমির খামার গড়ে তোলেন অতি সাহসী তরুণ উদ্যোক্তা মুশতাক আহমেদ। মালয়েশিয়ার সারওয়াত থেকে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি কুমির আনা হয়। খামারের ১৫ একর জমির মধ্যে প্রায় পাঁচ একর জমির ২০ হাজার বর্গফুট পুকুর এলাকায় ছেড়ে দেন এসব কুমির। পুকুরের চারদিকে সীমানা প্রাচীর টেনে দেয়া হয়।
প্রাকৃতিক পরিবেশে নিয়মিত মাছ-মাংস খেয়ে এসব কুমির বড় হতে থাকে। এর মধ্যে পর্যায়ক্রমে আটটি কুমির মারা যায়। পরে কুমিরগুলো প্রকল্পের পুকুরে ছাড়া হয়। এসব কুমিরের বয়স ১০ থেকে ১৪ বছর ছিল। কুমিরগুলো ৭ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১২ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা। কুমিরের গড় আয়ু ১০০ বছর। আমদানিকৃত কুমিরের মধ্যে ১৫টি পুরুষ রয়েছে। প্রতি মাসে এদের ৩০০ কেজি মাংস খাবার হিসেবে দেয়া হতো। ফার্মে ছয়-সাত বছর বয়সের একটি স্ত্রী কুমির বছরে একবার (এপ্রিল-মে মাসে) ৩০ থেকে ৪০টি করে ডিম দেয়।
ডিম ফুটতে সময় লাগে ৭০ থেকে ৮০ দিন। এখানে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফোটানোর ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে খামারে ৪০টি পুকুর রয়েছে। ২০০৮ সালে ১৭টি কুমির থেকে ডিম পাওয়া যায় ৯০০-এর মধ্যে বাচ্চা ফোটে প্রায় ২৪০টি। ২০০৯ সালে এসে ২৩টি কুমির থেকে ডিম পাওয়া যায় প্রায় ১ হাজার ১৫০টি। এই খামারে এখন কুমিরের বাচ্চা লালন-পালন হচ্ছে প্রায় ৮০৫টি। এর মধ্যে রপ্তানিযোগ্য হয়েছে প্রায় ১৪১টি বাচ্চা। দ্বিতীয় ব্যাচে রপ্তানির তালিকায় আছে প্রায় ২৪০টি। এসব কুমিরের আয়ু প্রায় শতবর্ষ এবং ডিম দেবে প্রায় ৩০ বছর। ২০১৩ সালে মালয়েশিয়ার সারওয়াত কুমির ফার্ম থেকে দেড় কোটি টাকা দিয়ে আরও ৪০ ব্রিডার কুমির ক্রয় করে আনা হয়েছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে এ খামারে ১০০টি ব্রিডার কুমির রয়েছে। এ ছাড়া এ খামারের নিজস্ব উৎপাদিত ছোট-বড় মিলে ১২-১৩ শতাধিক কুমির রয়েছে যেগুলোর দৈর্ঘ্য পাঁচ ফুট থেকে সাড়ে ছয় ফুট পর্যন্ত লম্বা।
জাপানে যাচ্ছে কুমিরের চামড়াঃ ভালুকা উপজেলার হাতিবেড় গ্রামের রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড নামে গড়ে ওঠা প্রজেক্টে বাণিজ্যিকভাবে কুমির চাষ করে ৪৩০টি কুমিরের চামড়া জাপানে রপ্তানি করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রজেক্টের নির্বাহী পরিচালক রাজিব সোম মিডিয়াকর্মীদের জানান, রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড থেকে ২২ ডিসেম্বর জাপানের হরিউঁচি ট্রেডিং কোম্পানি নামে একটি ট্যানারিতে ৪৩০টি কুমিরের চামড়া বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি করা হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা।
কুমিরের মাংস, দাঁত ও হাড় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এগুলোও রপ্তানির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। কুমিরের মাংস শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা হবে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১০ সালের জার্মানির একটি ইউনিভার্সিটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৬৭টি কুমির এক কোটি টাকায় বিক্রি করে। এ ছাড়া ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে উপহার হিসেবে পাঁচটি কুমির দেয়া হয়।
ঘুমধুমের কুমির চাষ প্রকল্পঃ কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তের ঘুমধুমে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কুমির চাষ প্রকল্পে উৎপাদন শুরু হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা থেকে ৭০ কিলোমিটার ও উখিয়া উপজেলা সদর থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে ঘুমধুম পাহাড়ি এলাকায় ২৫ একর জায়গার ওপর এ কুমির চাষ প্রকল্পটি গড়ে তুলেছে। আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আকিজ ওয়াল্ড লাইফ ফার্ম লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শেখ আজিজ উদ্দিন।
ঘুমধুম নামের অবহেলিত একটি ইউনিয়নে কুমির চাষ প্রকল্পের মতো একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় এলাকার অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পাশাপাশি এখানে একটি পর্যটন স্পট গড়ে তোলার পরিকল্পনাও তাদের রয়েছে। প্রকল্পে লালিত-পালিত ৩১টি মাদি কুমির ইতোমধ্যেই ৩০০ বাচ্চা প্রসব করেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী চার বছরের মধ্যে এ প্রকল্পে উৎপাদিত কুমির মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করে হাজার কোটি টাকা আয় করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তারা আশা করছেন, কুমির চাষের পাশাপাশি এ প্রকল্পে প্রজাপতি চাষ, বার্ড পার্কসহ কটেজ ও মিউজিয়াম হাউস গড়ে তুলে প্রকল্পটিকে একটি পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটিকে ২০১০ সালের শুরুতেই পরীক্ষামূলকভাবে ৫০টি কুমির উন্মুক্ত জলাশয়ে ছাড়া হয়। এর মধ্যে তিনটি কুমির মারা গেলেও বর্তমানে ৪৭টি কুমির সুস্থ রয়েছে। এ প্রকল্পে থাকা ৩১টি মাদি কুমির সম্প্রতি ৩০০ বাচ্চা প্রসব করে এর মধ্যে ১১টি বাচ্চা মারা গেলেও ২৮৯টি বাচ্চা সুস্থ আছে। আগামী চার বছর পর এসব কুমির মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করলে প্রায় হাজার কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানি তালিকায় কুমিরঃ দেশের অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির তালিকায় নতুন করে নাম লেখাচ্ছে কুমির। এ খাতে হাজার হাজার সাহসী বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গত ২০০৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় ৫০ হাজার কুমির হাত বদল হয়েছে। গত ২০০৮ সালে বিশ্বের এক দেশ থেকে অন্য দেশে কুমির রপ্তানির সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার। দেশীয় এবং স্থানীয়ভাবে কুমির খামারগুলো দর্শনীর বিনিময়ে বিনোদন এবং আয়ের উৎস হতে পারে। পাশাপাশি এ খাতে হাজার হাজার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। বর্তমানে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে কুমিরের চাষ হচ্ছে।
লেখক : কৃষি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক