কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ক্যাপসিকাম বা মিষ্টি মরিচ সারা বিশ্বেই একটি জনপ্রিয় সবজি। বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। মিষ্টি মরিচের আকার ও আকৃতি বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তবে সাধারণত ফল গোলাকার ও ত্বক পুরু হয়। মিষ্টি মরিচ আমাদের দেশীয় প্রচলিত সবজি না হলেও ইদানিং এর চাষ প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষ করে বড় বড় শহরের আশেপাশে সীমিত পরিসরে কৃষক ভাইয়েরা এর চাষ করে থাকের, যা অভিজাত হোটেল ও বিভিন্ন বড় বড় মার্কেটে বিক্রি হয়ে থাকে। এ ছাড়া মিষ্টি মরিচের বিদেশে রপ্তানীর সম্ভাবনাও প্রচুর। কারণ সারা বিশ্বে টম্যাটোর পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সবজি হচ্ছে মিষ্টি মরিচ।
মিষ্টি মরিচের পুষ্টিমান ও ব্যবহার:
পুষ্টিমানের দিক থেকে মিষ্টি মরিচ একটি অত্যন্ত মূল্যবান সবজি। প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ’সি’ থাকার কারণে এবং অতি সহজেই টবে চাষ করা যায় বলে দেশের জনসাধারণকে মিষ্টি মরিচ খাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
মিষ্টি মরিচ লাগানোর নিয়ম কানুন:
ক্যাপসিয়াম বা মিষ্টি মরিচ চাষের জন্য দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি ভালো। মিষ্টি মরিচ খরা ও গোড়ায় পানি জমা কোনটিই সহ্য করতে পারে না। মিষ্টি মরিচের বীজ বোনার উপযুক্ত সময় হলো অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। প্রতি শতকের জন্য ১ গ্রাম বীজ দরকার হয়। বীজ থেকে প্রথমে চরা তৈরি করে নিতে হয়। এ জন্য বীজগুলোকে ১২ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে আগে থেকে তৈরি করে রাখা বীজতলায় ১০ সেমি. দূরে দূরে লাইন করে বীজ বুনতে হবে। বীজ বোনার ৭-১০ দিন পর চারা ৩-৪ পাতা হলে মাঝারি আকারের পলিথিন ব্যাগে চারা স্থানান্তর করতে হবে।
এরপর মূল জমি চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে তৈরি করে নিতে হবে। এরপর বেড তৈরি করে নিতে হবে। প্রতিটি বেড চওড়া ২.৫ ফুট রাখতে হয়। দুই বেডের মাঝখানে নালা রাখা দরকার। প্রতি শতক জমির জন্য গোবর ৪০ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ১.৪ কেজি, এমওপি ১ কেজি, দস্তা ২০ গ্রাম এবং জিপসাম ৪৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। এর মধ্যে অর্ধেক গোবর সার জমি তৈরির সময়, বাকি অর্ধেক গোবর সম্পূর্ণ টিএসপি, দস্তা, জিপসাম, ১/৩ ভাগ এমওপি এবং ১/৩ ভাগ ইউরিয়া চারা রোপণের গর্তে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি ২/৩ ভাগ ইউরিয়া এবং এমওপি পরবর্তীতে দুইভাগ করে চারা রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত ৩০ দিন বয়সের চারা তৈরি করা বেডে ১.৫ ফুট দূরে দূরে লাইনে রোপণ করা হয়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারি প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রাতের তাপমাত্রা অনেক কমে যায় বলে পলিথিনের ছাউনি দিয়ে রাখলে ভেতরের তাপমাত্রা বেশি থাকে।
যেহেতু, ক্যাপসিকাম খরা ও জলাবদ্ধতা কোনটাই সহ্য করতে পারে না, তাই প্রয়োজন অনুসারে জমিতে সেচ দিতে হবে। কোন গাছে ফল ধরা শুরু হলে খুঁটি দিতে হবে যাতে গাছ ফলের বারে হেলে না পড়ে। জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
জাতঃ- আমাদের দেশে আবাদকৃত জাতগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে– California Wonder, Tender Bell (F1)এবং Yolow Wonder ইত্যাদি । প্রতি বছর এগুলোর বীজ আমদানি করতে হয়। তবে আমাদের দেশে California Wonder এর বীজ উৎপাদন করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
জীবন কালঃ- জাত ও মৌসুমভেদে ক্যাপসিকামের জীবনকাল ১২০ থেকে ১৪০ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বীজ বপনের সময়ঃ- অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস।
ফসল তোলা:
মিষ্টি মরিচ সাধারণত পরিপক্ক সবুজ অবস্থায় লালচে হওয়ার আগেই মাঠ থেকে উঠানো যায়। সাধারণত সপ্তাহে একবার গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ফল সংগ্রহের পর ঠান্ডা অথচ ছায়াযুক্ত স্থানে বাজারজাতকরণেল পূর্ব পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হয়। তবে ফল সংগ্রহের সময় প্রতিটি ফলে সামান্য পরিমাণে বোটা রেখে দিতে হবে।
রোগ-বালাই ,পোকামাকড় ব্যবস্থাপনাঃ-
জাবপোকা (এফিড) কারনে ক্ষতির লক্ষণঃ- প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক জাবপোকা দলবদ্ধভাবে গাছের পাতার রস চুষে খায়। ফলে পাতা বিকৃত হয়ে যায়, বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও প্রায়শ নিচের দিকে কোঁকড়ানো দেখা যায়। জাবপোকার শরীরের পেছন দিকে অবস্থিত দু’টি নল দিয়ে মধুর মতো এক প্রকার রস নিসরণ করে। এই রস পাতা ও কান্ডে আটকে গেলে তাতে সুঁটিমোল্ড নামক এক প্রকার কালো রঙের ছত্রাক জন্মায় এবং তার ফলে গাছের সবুজ অংশ ঢেকে যায় এবং সালোকসংশ্লেষণ ক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। মেঘলা, কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঠান্ডা আবহাওয়ায় এর বংশ বৃদ্ধি বেশি হয়। প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হলে এর সংখ্যা কমে যায়।
দমন ব্যবস্থাঃ- প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাবপোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা যায়। নিম বীজের দ্রবণ (১ কেজি পরিমাণ অর্ধভাঙ্গা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে) বা সাবান গোলা পানি (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২ চা চামচ গুঁড়া সাবান মেশাতে হবে) স্প্রে করেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। লেডি বার্ড বিটলের পূর্ণাঙ্গ ও কীড়া এবং সিরফিড্ ফ্লাই এর কীড়া জাবপোকা খেয়ে প্রাকৃতিকভাবে দমন করে। সুতরাং উপরোক্ত বন্ধু পোকা সংরক্ষণ করলে এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কম হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে শুধু আক্রান্ত স্থানসমূহে কীটনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি বিষক্রিয়া সম্পন্ন কীটনাশক, যেমন- ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মি. লি. হারে অথবা পিরিমর ৫০ ডিপি প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। মৌমাছি বা পরাগায়নে সাহায্যকারী পোকাদের জন্য অনেকটা নিরাপদ। বিষ প্রয়োগের এক সপ্তাহের মধ্যে খাওয়ার জন্য কোনো ফল সংগ্রহ করা যাবে না।
থ্রিপস পোকায় ক্ষতির লক্ষণঃ- পূর্ণাঙ্গ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক থ্রিপস পাতা থেকে রস চুষে খায়। পাতার মধ্যশিরার নিকটবর্তী এলাকা বাদামি রঙ ধারণ করে ও শুকিয়ে যায়। নৌকার খোলের পাতা ওপরের দিকে কুঁকড়িয়ে যায়। গাঢ় বাদামি রঙের পূর্ণাঙ্গ থ্রিপস পোকা খুবই ছোট, সরু ও লম্বাকৃতির। খালি চোখে কোনোমতে এদের দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাঃ- পাঁচ গ্রাম পরিমাণ গুঁড়া সাবান প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা। ক্ষেতে সাদা রঙের ৩০ সে.মি. – ৩০ সে.মি. আকারের বোর্ডে পাতলা করে গ্রিজ বা আঠা লাগিয়ে কাঠির সাহায্যে ৩ মিটার দূরে দূরে আঠা ফাঁদ পেতে থ্রিপস পোকা আকৃষ্ট করে মারা। এক কেজি আধা ভাঙা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি স্প্রে করা। আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি জাতীয় কীটনাশক (প্রতি লিটার পানিতে ২ মি. লি. পরিমাণ) স্প্রে করা।
লালমাকড় (মাইট)- এর কারনে ক্ষতির লক্ষণঃ- লালমাকড় খাওয়া পাতায় হলুদাভ ছোপ ছোপ দাগের সৃষ্টি হয়। যখন এই ধরনের আক্রমণ পাতার নিচে দিকে মাঝখানে বেশি হয় তখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই পাতা কুঁকড়িয়ে যেতে দেখা যায়। ব্যাপক আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ পাতা হলুদ ও বাদামি রঙ ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত পাতা ঝরে পড়ে। লালমাকড় পাতার নিচের পৃষ্ঠদেশে অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিম পাড়ে যা খালি চোখে দেখা যায় না। এই ডিম থেকে কমলা রঙের বাচ্চা বের হয়ে বেগুন পাতার নিচের পৃষ্ঠদেশ খেতে থাকে। এক সপ্তাহের মধ্যেই বাচ্চাগুলো গাঢ়-কমলা বা লাল রঙের পূর্ণ মাকড়ে পরিণত হয় যারা দেখতে ক্ষুদ্র মাকড়সার মতো। এদের পাতার নিচের পৃষ্ঠদেশে চলাফেরা করতে দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাঃ- নিমতেল ৫ মি. লি. + ৫ গ্রাম ট্রিকস্ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা। এক কেজি আধাভাঙা নিমবীজ ১০ লিটার পানিতে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি পাতার নিচের দিকে স্প্রে করা। আক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি হলে নিউরন ৫০০ ইসি অথবা টর্ক ৫৫০ এস সি ২ মি.লি. হারে প্রতি লিটার পানির সাথে স্প্রে করা যেতে পারে। মাকড়নাশক ওমাইট বা টলস্টার (প্রতি লিটার পানিতে ২ মি. লি. পরিমাণ) স্প্রে করা।
রোগবালাইঃ-
এ্যানথ্রাকনোজের রোগের লক্ষণঃ- পাতায় বসানো দাগ হয়। ফলেও এ দাগ দেখা যায়। পাতা ঝরে পড়ে এবং ফল পচে যায়। পাতায় গোলাকৃতি দাগ দেখা যায়। কুয়াশায় পাতার পচন লক্ষ করা যায়। প্রথমে মধ্যাংশ একটু উঁচু ছোট কালো দাগ হয়। দাগ বাড়তে থাকে এবং পুরো ফলে কালো ছোপ ছোপ দাগ হয়ে ফল পচে যায়। উক্ত ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করলে পরের বছর চারা গজায় না। দমন ব্যবস্থা : ব্যাভিষ্টিন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে গুলে ১৫ দিন পর পর স্প্রে করা। রোগমুক্ত ভালো বীজ ব্যবহার করতে হবে। ফল পুরোপুরি না পাকিয়ে তুলে নিতে হবে। ক্যাপসিকামের বীজ-ফলে অবশ্যই ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে বীজ রোগমুক্ত রাখতে হবে।
ব্লাইট রোগের লক্ষণঃ- পাতায় দাগ হয়। পাতা ঝলসে যায়।
দমন ব্যবস্থাঃ- ব্যাভিষ্টিন ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে গুলে ১৫ দিন পর পর স্প্রে করা। রোগমুক্ত ভালো বীজ ব্যবহার করতে হবে।
উইল্টিং রোগের লক্ষণঃ- গাছ আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে এবং মারা যায়। দমন ব্যবস্থা : আক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলা এবং জমিতে প্লাবন সেচ না দেয়া।
কৃপ্র/ এম ইসলাম