‘বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রকৃতি পাম চাষের উপযোগী’
ইতিহাস: পাম তেলের আদি উৎস পশ্চিম আফ্রিকা। পাম তেলের মিশরে আবির্ভাব ঘটেছে সম্ভবত: পশ্চিম আফ্রিকা থেকে। মালয়েশিয়ায় ১৯১০ সালে Scotsman William Sime এবং Henry Darby নামের দুই ভদ্রলোক পাম চাষের প্রর্বতন করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম দফা পাম বীজ মালয়েশিয়া থেকে আনা হয় এবং পলিথিন ব্যাগে ঢাকা বোটানিক্যাল গার্ডেনে চারা উৎপাদন করা হয়। ১৯৭৯ সালে মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়া থেকে আনা চারা দ্বারা প্রথম পাম চাষ শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে কক্সবাজার এবং সিলেট বনবিভাগকে ছয় মাস বয়সের চারা রোপণের জন্য সরবরাহ করা হয় । ১৯৮১ সালে কক্সবাজারে ৩২৫ একর, চট্টগ্রামে ২৭৯ একর এবং সিলেটে ১৮০ একর মিলে মোট ৭৮৪ একর পাম চাষের আওতায় আনা হয়।
পুষ্টিমান: সদ্য আহরিত পাম তেল বিটা ক্যারোটিনের সমৃদ্ধতম উৎস। পাম তেলে টোকোফেরল ও টোকোট্রায়েনল নামক দুই ধরনের ভিটামিন ‘ই’ অধিক পরিমাণে থাকে। অন্যান্য উদ্ভিজ্জ ভোজ্য তেলের মত পাম তেলও কোলেস্টেরলমুক্ত। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হল খাদ্যে পাম তেল ব্যবহার করলে রক্তে মোট কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে না। পাম তেল খাদ্যে ব্যবহার করলে দেহে উপকারী ‘এইচ.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে এবং ক্ষতিকর ‘এল.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়। পাম তেল রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা হ্রাস করে ফলশ্রুতিতে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
লাল পাম তেলে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন এবং ভিটামিন ‘ই’ থাকে। যা গাজরের চেয়ে ১৫ গুন এবং টমেটোর চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি। লাল পাম তেল ক্যারোটিনয়েডের উৎস হওয়ায় কয়েক ধরনের ক্যান্সারকে কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে পারে। পাম তেল এবং একই পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত অন্য ভোজ্য তেল সম্বলিত খাদ্যের সাথে তুলনা করে দেখা গেছে যে পরীক্ষামূলকভাবে ঘটানো স্তন্য ক্যান্সারের সংঘটন ও বিকাশ উভয় ক্ষেত্রেই পাম তেল প্রতিরোধমূলক ভূমিকা পালন করে।
যুক্তরাষ্ট্র্য ও যুক্তরাজ্যের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ভোজ্য তেলের মধ্যে ৫০ পি.পি.এম. পর্যন্ত কোলেস্টেরল থাকলে তা ‘কোলেস্টেরল মুক্ত’ তেল হিসেবে বিবেচিত হয়। পাম তেলের কোলেস্টেরল ৫০ পি.পি.এম. এর নিচে যা (১৩-১৯) পি.পি.এম. এর মধ্যে। অপরপক্ষে সয়াবিন তেলে (২০-৩৫) পি.পি.এম. সূর্যমুখী তেলে (০৮-৪৪) পি.পি.এম.এবং সরিষার তেলে (২৫-৮০) পি.পি.এম. কোলেস্টেরল বিদ্যমান। চীনে পাম তেল, সয়াবিন তেল, পিনাট তেল এবং শুকরের চর্বি (সবগুলোই সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত) নিয়ে এক তুলনামূলক গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে এদের মধ্যে পাম তেল দেহে উপকারী ‘এইচ.ডি.এল.’কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায় এবং ক্ষতিকর ‘এল.ডি.এল.’ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
বিবিধ ব্যবহার: পরিশোধিত পাম তেল গন্ধহীন হওয়ায় এর দ্বারা ভাজা খাদ্যেও স্বাভাবিক গন্ধ বজায় থাকে। পাম তেল অর্ধজমাট ঘনত্বে থাকার জন্যে এমন কিছু ভৌতগুণ ধারন করে যা অনেক খাদ্য প্রস্তুতিতে প্রয়োজন হয়। পাম তেল ভোজ্য তেল ছাড়াও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। সাবান, ডিটারজেন্ট, ফ্যাটি এসিড, ফ্যাটি এ্যলকোহল, গি্লসারল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়।
বিস্কুট, কেক, আইসক্রীমসহ বিভিন্ন প্রকার খাবার তৈরিতে পাম তেলের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। চর্বি উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে পাম তেল সকলের পছন্দনীয়। পাম তেল থেকে তৈরি হয় সলিড ফ্যাট যেমন বনস্পতি যা স্বাস্থ্যের জন্য উত্তম কারণ পাম তেলকে হাইড্রোজিনেশন করার প্রয়োজন হয় না বলে এতে ক্ষতিকর ট্রান্স ফ্যাটি এসিড থাকে না। পাম গাছের কাণ্ড, পাতা, ফলশূন্য কাঁদি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করা যায়।
পাম গাছের পাতা ও ফলশূন্য কাঁদির আঁশকে প্রক্রিয়াজাত করে মধ্য ঘনত্বের ফাইবার বোর্ড ও চিপবোর্ড তৈরি করা যায়। পাম গাছের গুঁড়ি থেকে চমৎকার আসবাবপত্র করা যায়। পাম গাছের পাতা মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে। এক টন পাম গাছের পাতা মাটিতে প্রায় ৭.৫ কেজি নাইট্রোজেন, ১.০৬ কেজি ফসফরাস, ৯.৮১ কেজি পটাশিয়াম ও ২.৭৯ কেজি ম্যাগনেশিয়াম যোগ করে ।
চাষাবাদ: পাম গাছ চাষের জন্য মোটামুটি তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৩২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড হলে ভাল। বাংলাদেশের গড় বৃষ্টিপাত ১৫০সেন্টিমিটারের বেশি তাই বাংলাদেশে পাম চাষের উজ্জ্বল সম্ভবনা রয়েছে। প্রতিদিন ৫ ঘন্টা অথবা বার্ষিক মোট ২০০০ ঘন্টা সূর্যালোক দরকার। সমতল, ভারী, পানি ধারনক্ষম পলিমাটি পাম চাষের জন্য আদর্শ। বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকা, অনাবাদি জমি, সড়ক-মহাসড়কের পাড়, পুকুর পাড়, অব্যবহৃত স্থানে পাম গাছ রোপণ করা যেতে পারে। প্রতি হেক্টর জমিতে ১২০টি থেকে ১৫০টি চারা অথবা ৯.৫ মিটার দূরে দূরে প্রতি হেক্টর জমিতে ১২৮টি চারা রোপণ করা যায়।
বীজ হতে চারা তৈরি করতে এক বছর সময় লাগে। চারা রোপণের তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ফল ধরে। রোপিত চারা ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত ফল দিতে পারে। ৯.৫ মিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গর্ত করতে হবে। প্রতিটি গর্তের আকার ২×২×২ ঘন ফুট। প্রতিটি গর্ত জৈব সার দ্বারা ভরাট করতে হবে। জৈব সার শোধন করার জন্য একদিন (২৪ ঘন্টা) তামাক পাতা ভেজানো পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রতিটি গর্তে ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০০ গ্রাম টিএসপি এবং ৫০০ গ্রাম এমওপি সার প্রাথমিক মাত্রা হিসেবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে চারা রোপণের আগে অবশ্যই গতের্র জৈব সার বা কম্পোস্ট ভালভাবে ওলট-পালট করে গ্যাস বের করে দিতে হবে যাতে চারা গাছের কোন ক্ষতি না হয়। চারা রোপণের পর সবসময় মাটিতে যাতে পানি থাকে সেজন্য সেচ দিতে হবে।
ইঁদুরের আক্রমণ রোধ করার জন্য শতকরা ২ ভাগ জিংক ফসফাইট বিষটোপ ব্যবহার করে যেতে পারে। গন্ডার পোকার আক্রমণে গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়। গোঁড়া পচা রোগ যা Ganoderma boninense নামক জীবাণুর আক্রমণে ঘটে। এ রোগের কারণে শতকরা ৫০ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যেতে পারে। আইপিএম পদ্ধতিতে পোকাদমন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আক্রমণ রোধ করা যেতে পারে। ব্যাগওয়ার্ম ও ক্যাটারপিলারের আক্রমণ রোধ করার জন্য জৈব বালাইনাশক যেমন ব্যাকটেরিয়া Bacillus Thuringensis ব্যবহার করে যেতে পারে।
ফল সংগ্রহ: সারা বছরই পাম গাছ থেকে ফল পাওয়া যায়। ফিলিপাইনের আরবিএপি (জইঅচ) এর একটি প্রকাশনা অনুযায়ী চারা রোপণের ২৬ মাস থেকে ৩০ মাসের মধ্যেই ফসল সংগ্রহের পর্যায়ে পৌছায়। এক হেক্টর জমির পূর্ণবয়স্ক গাছে গড়ে বছরে কাঁদিসহ ফল ১৯.১ মে.টন পাওয়া যায়। মাসে তিন বার বা ১০ দিন পর পর ফল সংগ্রহ করা ভাল।
তেল প্রস্তুত: পরিপক্ক ফলগাছ থেকে কাঁদিসহ কেটে নামিয়ে পরিস্কার করতে হবে। তারপর ফলগুলোকে পাত্রের মধ্যে পানিসহ ফুটাতে হবে এতে ফলগুলো নরম হয়। এবার নরম ফলগুলোকে হাতে চেপে রস বের করতে হবে। তারপর পানি মিশ্রিত এ রসকে একটি পাত্রে রেখে চুলায় কিছুক্ষণ তাপ দিলে রসে বিদ্যমান পানি বাষ্পাকারে বের হয়ে যাবে এবং পাত্রের মধ্যে পাম তেল জমা থাকবে। এ ভাবে প্রাপ্ত তেল ছেঁকে বোতলে সংগ্রহ করে রাখলে ছয় মাস পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোটা, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা এবং সর্বোপরি ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিজ নিজ আঙ্গিনা ও অব্যবহৃত স্থানে পাম গাছের রোপণের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সকলে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে পাম তেল একদিন হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের চাবিকাঠি।
সংকলনে: মুহম্মদ আরশেদ আলী চৌধুরী, মেহেরপুর
কৃপ্র / এম ইসলাম