কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বাংলাদেশে ডাল ফসলের মধ্যে খেসারি কলাইয়ের মোট আবাদী এলাকা এবং উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। খেসারি কলাই উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করা সম্ভব। আমাদের দেশের অনেক অঞ্চলে এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে খেসারি কলাই চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। চাষ সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানতে হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
খেসারি কলাই বাংলাদেশের ডাল ফসলের মধ্যে অন্যতম। এর ইংরেজি নাম Grass pea বা Chikling pea এবং বৈজ্ঞানিক নাম Lathyrus sativus L. এটি হচ্ছে একটি আমিষ জাতীয় খাদ্য ফসল। বাংলাদেশে ডাল ফসলের মধ্যে খেসারি কলাইয়ের মোট আবাদী এলাকা এবং উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। তবে পাবনা, বরিশাল, ঢাকা, রাজশাহী ও ফদিরপুরে খেসারি কলাইয়ের উৎপাদন বেশি হয়। খেসারির দাম কম হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে এর ব্যবহার বেশি।
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ মাংস থেকে তাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে খেসারির ডাল আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারে। তাই সব শ্রেণীর মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য খেসারির ডাল হচ্ছে খুব জনপ্রিয় একটি ফসল। খেসারি কলাই উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করা সম্ভব। এছাড়া দেশের চাহিদা মেটানোর পর অতিরিক্ত উৎপাদন বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সহায়তা দিয়ে থাকে। খেসারি কলাই বিদেশে রপ্তানি করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
পুষ্টিগুনঃ খেসারি কলাই-এ শতকরা প্রায় ২০-২৩ ভাগ আমিষ থাকে।
কার্তিক মাসে থেকে অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি (মধ্য অক্টোবর থেকে নভেম্বর) সময়ে খেসারি কলাই-এর বীজ বপন করতে হয়। দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি খেসারি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী।
জাতঃ বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট খেসারি কলাই-এর ২টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
বারি খেসারি-১
১. ১৯৯৫ সালে বারি খেসারি-১ জাতটি চাষের জন্য অনুমোদন করা হয়েছে।
২. বাংলাদেশের সব অঞ্চলে এ জাত চাষ করা যায়।
৩. বারি খেসারি-১ জাত স্থানীয় জাতের তুলনায় শতকরা ৪০ ভাগ পর্যন্ত বেশি ফলন দেয়।
৪. এ জাতের গাছের রঙ গাঢ় সবুজ এবং এতে প্রচুর শাখা-প্রশাখা আছে।
৫. বারি খেসারি-১ জাতের ১ হাজার বীজের ওজন ৪৮-৫২ গ্রাম।
৬. ফসল পাকতে ১২৫-১৩০ দিন সময় লাগে।
৭. প্রতিবিঘা জমি থেকে প্রায় ২০০ কেজি খেসারি কলাই পাওয়া যায়।
৮. এই জাত পাউডারি ও ডাউনি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধী।
বারি খেসারি-২
১. ১৯৯৬ সালে বারি খেসারি-২ জাতটি সারাদেশে আবাদের জন্য অনুমোদন করা হয়েছে।
২. গাছের উচ্চতা ৫৫-৬০ সে.মি.। পাতা স্থানীয় জাতের তুলনায় বেশি চওড়া ও ফুলের রঙ নীল।
৩. বীজের আকার একটু বড় ও হালকা ধূসর রঙ-এর।
৪. বারি খেসারি-২ জাতের বীজের ওজন ৫০-৫৫ গ্রাম।
৫. এতে আমিষের পরিমাণ ২৪-২৬% থাকে।
৬. বীজ বপন থেকে ফসল পাকা পর্যন্ত ১২৫-১৩০ দিন সময় লাগে।
৭. প্রতিবিঘা জমি থেকে প্রায় ২৫০ কেজি খেসারি কলাই পাওয়া যায়।
জমি তৈরিঃ রিলে ফসল হিসাবে খেসারি সাধারণত আমন ধান কাটার প্রায় এক মাস আগে জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা অবস্থায় ছিটিয়ে বপন করা হয়। সেজন্য জমি চাষের প্রয়োজন হয় না। একক ফসল হিসাবে আবাদের ক্ষেত্রে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে নিতে হবে। রিলে ফসল হিসেবে চাষ করলে আমন ধান কাটার প্রায় এক মাস আগে জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা অবস্থায় বীজ ছিটিয়ে বপন করতে হবে। একক ফসল হিসেবে বীজ ছিটিয়ে বপন করা যাবে। সারিতেও বীজ বপন করা যায়। বীজ সারিতে বপন করলে এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ৫০ সে. মি. রাখতে হবে।
সার প্রয়োগঃ কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে খেসারি কালাই চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুয়ায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশেপাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সেচ ও নিষ্কাশনঃ খেসারি কলাই চাষের সময় জমিতে রসের অভাব হলে প্রয়োজন মত ও নিয়মিত সেচ দিতে হবে। একক ফসল হিসেবে চাষ করলে জমি তৈরির সময় জমিতে রসের অভাব হলে সেচ দিয়ে জমি চাষ করতে হবে।
রোগ বালাইঃ পেরোনোসপোরা ভিসি নামক ছত্রাকের আক্রমণে খেসারির ডাউনি মিলডিউ রোগ হয়। রোগে আক্রান্ত খেসারি গাছের পাতা কিছুটা হলদে হয়ে যায়। পাতার নিচে ছত্রাকের অবস্থান খালি চোখেই দেখা যায়। রোগের মাত্রা বেশি হলে পাতা কুঁচকে ও ঝলসে যায়। এ ছত্রাকের জীবাণু মাটিতে ১-২ বছর বেঁচে থাকতে পারে।
প্রতিকারঃ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময় পরিচর্যা
১. জমিতে আগাছা থাকলে পোকামাকড়, রোগজীবাণু ও ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
২. মাটির ঢেলা ভেঙ্গে দিতে হবে এবং মাটি ঝরঝরে রাখতে হবে।
ফসল সংগ্রহঃ ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি) মাসে ফসল সংগ্রহ করতে হবে।
উৎপাদিত ফসলের পরিমাণঃ প্রতি বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমি থেকে প্রায় ৪-৫ মণ খেসারি কলাই পাওয়া সম্ভব।
তথ্যসূত্র : কৃষি প্রযুক্তি হাতবই, বি এ আর উদ্ভাবিত কৃষি প্রযুক্তির বিবরণী, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর-১৭০১।
কৃপ্র/ এম ইসলাম