কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ শীতকালীন সবজি ফুলকপিতে মানবদেহে সহনীয় মাত্রার ৩৬ গুণ বেশি কীটনাশকের উপস্থিতি পেয়েছে ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ল্যাবরেটরিতে বেগুন, লালশাক ও শিমের যে নমুনা পরীক্ষা করা হয়, সেগুলোতেও ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে কোনো কোনো নমুনা সম্পূর্ণ নিরাপদও ছিল।
ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল) জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত। গবেষণাগারটি ২০১৩ সাল থেকে ১০৭ ধরনের খাদ্য ও পানীয় পরীক্ষা করে আসছে। এনএফএসএলের পর্যবেক্ষণ হলো, কৃষিতে কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে শাকসবজি, ফলমূলে ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশক পাওয়া যাচ্ছে।
ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির প্রধান গবেষক শাহনিলা ফেরদৌসী বলেন, ‘আমরা আমাদের গবেষণাগারে এবার ফুলকপি, শিম, লালশাক ও বেগুনে আট ধরনের কীটনাশকের উপস্থিতি পেয়েছি। কোনো কোনো নমুনায় এর মাত্রা ছিল খুব বেশি। তবে কোনো কোনো নমুনা ছিল একদমই নিরাপদ।’ শীতকালীন ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিকল্পনাও তাঁদের আছে বলে জানান শাহনিলা ফেরদৌসী।
ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা কৃষকদের এবং পাইকারি ও খুচরা বাজার থেকে ফুলকপি, বেগুন, লালশাক ও শিমের মোট ১০৮টি নমুনা সংগ্রহ করেন। নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হয় নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ সদর, কাপাসিয়া, সাভার, কেরানীগঞ্জ, কালিয়াকৈর ও ধামরাইয়ের কৃষকদের কাছ থেকে। এ ছাড়া শ্যামগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, কারওয়ান বাজার, আমিনবাজার, টঙ্গী ও মিরপুরের পাইকারি বাজার এবং নিউমার্কেট, বনানী, মালিবাগ, মিরপুর, কচুক্ষেত, শান্তিনগর ও মহাখালীর খুচরা বাজার থেকেও নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
গবেষণায় ২৭টি ফুলকপির মধ্যে আটটিতে ম্যালাথিয়ন, ক্লোরোপাইরিফস, প্যারাথিয়ন মিথাইল ধরনের কীটনাশক ক্ষতিকর মাত্রায় পাওয়া গেছে। এই আটটির চারটি কৃষকদের কাছ থেকে নেওয়া। এগুলোয় সহনীয় মাত্রার ১২ থেকে ৩৬ গুণ পর্যন্ত কীটনাশক ছিল। পাইকারি বাজার থেকে সংগৃহীত ফুলকপিতে ৩ থেকে ৮ গুণ এবং খুচরা বাজারে ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি কীটনাশক পাওয়া গেছে।
ফুলকপির প্রতি কেজিতে ২০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ম্যালাথিয়ন মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রা, কিন্তু পাওয়া গেছে ৭২৯ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। আবার ক্লোরোপাইরিফস প্রতি কেজিতে ৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১৬০৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত।
বেগুনের ২৭টি নমুনার ১২টিতে কুইনালফস পাওয়া গেছে ১৪ গুণ বেশি। প্রতি কেজিতে কুইনালফস ১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১২৮ দশমিক ২৮ মিলিগ্রাম পর্যন্ত।
শিমের ২৭টি নমুনার ৯টিতে ক্ষতিকর কীটনাশক ডাইমেথয়েট পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার ২০ গুণ বেশি। এক কেজি শিমে ২০ গ্রাম পর্যন্ত ডাইমেথয়েট সহনশীল, পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৪২৪ মিলিগ্রাম। ক্লোরোপাইরিফস ও মেটালাক্সিলও পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি।
লালশাকের ২৭টি নমুনার মাত্র তিনটিতে ক্লোরোপাইরিফস পাওয়া গেছে। তবে এর মাত্রা ছিল ২৮ থেকে ৩১ গুণ পর্যন্ত। মানবদেহে প্রতি কেজি লালশাকে ৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত সহনীয় হলেও পাওয়া গেছে ১৫৭৭ মিলিগ্রাম পর্যন্ত।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. সুলতান আহমেদ বলেছেন, তাঁরাও গবেষণায় শীতকালীন সবজিতে ক্ষতিকর কীটনাশকের অবশেষ পাচ্ছেন। এর আগে তাঁর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল ২০১১-২০১৪ সাল পর্যন্ত যশোর, জামালপুর, বগুড়া, নরসিংদী, গাজীপুর, কুমিল্লা অঞ্চল থেকে শাকসবজির ৩৬২টি নমুনা সংগ্রহ করেছিল।
বারির পেস্টিসাইড অ্যানালিটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে তাঁরা দেখেছেন, নমুনাগুলোর ২৩ শতাংশে কীটনাশকের অবশেষ ছিল। ওই গবেষণার আওতাভুক্ত শাকসবজিগুলো ছিল শিম, বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি, করলা, চিচিঙ্গা, পটোল, শসা, ঢ্যাঁড়স ও ধনেপাতা। তিনি আরও বলেন, জাপানে বাংলাদেশের তুলনায় সাত গুণ বেশি কীটনাশক ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শুধু কীটনাশকের যৌক্তিক ব্যবহারের কারণে তাদের শস্য ও শাকসবজি-ফলমূলে কীটনাশকের অবশেষ থাকছে না।
বারির কীটতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, কীটনাশক ব্যবহারের কিছু নিয়ম আছে। যেসব কীটপতঙ্গ পাতার ওপর বসে শাকসবজি চুষে খায়, সেগুলো নির্মূল করতে ক্লোরোপাইরিফস ও কুইনালফস ব্যবহৃত হয়। একবার ছিটানোর ১০-১৫ দিন পর পর্যন্ত আর ওষুধ দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু অনেক সময় কৃষকেরা কীটনাশক প্রয়োগের দিন তিনেকের মাথায় শাকসবজি বিক্রি করছেন। ফলে কীটনাশকের অবশেষ রয়েই যাচ্ছে। ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনে সাইপারমেথ্রিন বহুল প্রচলিত কীটনাশক। এর প্রভাব চার দিন পরই চলে যায়। মাঠপর্যায়ে অনেক সময় কৃষকেরা এই চার দিন সময়ও অপেক্ষা করছেন না।
কৃষি মন্ত্রণালয় পাঁচ বছর ধরে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। এই প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা দেশে মোট ৪০০টি প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছেন। কৃষকেরা বলেছেন, কীটনাশক ব্যবহার সম্পর্কে তাঁরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে যথেষ্ট তথ্য পান না।
ঢাকায় শীতকালীন সবজির বড় অংশ আসে যশোর থেকে। যশোরের কাশেমপুর ইউনিয়নের দৌলতদি গ্রামের কৃষক মো. দাউদ হোসেন বলেন, ‘আগে কীটনাশক বেচার সময় বলত, এইটা কড়া। তিন-চার দিন আগে ধরাই যাবিনে। এখন আর কেউ কিছু কচ্ছে না। এত কীটনাশক ব্যবহার হয় যে খাওয়াই বিরাট কষ্ট হয়ি যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ বেশি কড়া ওষুধ চায়। তখন ওরাও (বিক্রেতা) গতি বাড়ায়ে দেয়।’
জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি কীটনাশক: এ মুহূর্তে কীটনাশক একটা বড় হুমকি বলে মনে করছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এর প্রথম শিকার হচ্ছে শিশুরা। আর দীর্ঘ মেয়াদে জটিল রোগে ভুগছেন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, শাকসবজিতে যেসব কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে সেগুলো পেটে গেলে শ্বাসকষ্ট, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া, চুলকানি, বমি, পেটে ব্যথা, ডায়রিয়া, হাঁপানি থেকে শুরু করে হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
২০০৯ সালে ধামরাইয়ে ৩ জন এবং ২০১৩ সালে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে রহস্যজনক কারণে ১৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। আইইডিসিআরের তথ্যমতে, এসব মৃত্যুর কারণ ছিল খাদ্যে ব্যবহৃত কীটনাশক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান অবশ্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, ধানখেতে কীটনাশকের ব্যবহার ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে কমানো গেছে। তবে শাকসবজি ও ফলমূলের ক্ষেত্রে কীটনাশকের ব্যবহার সন্তোষজনক পর্যায়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, দেশে কীটনাশক আমদানি ও বাজারজাতকরণের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাজার খানেক।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য হলো, কীটনাশক আমদানির পরিমাণ আগের চেয়ে কমেছে। ১৯৯৬-৯৭ সালের তুলনায় ২০০৯-১০ সালে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছিল। কিন্তু ২০১০-১১ সালে আমদানি কমেছে ৩৩৯৭ মেট্রিক টন। তবে গত জুনে বিনিয়োগ বোর্ড থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয়েছে, কীটনাশকের বিষের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে আমদানির অনুমতি পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই কৃষক ওই কীটনাশক কিনছেন। ফলে পরিমাণের দিক থেকে কীটনাশকের আমদানি কমলেও তাতে বিষের পরিমাণ কত, তার কোনো পরীক্ষা হচ্ছে না বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ ছাড়া কীটনাশক ব্যবহার না করতে কৃষকদের পরামর্শ দেয়। কীটনাশকের গায়ে লেখা ব্যবহার বিধি অনুসরণ করতে হবে। বেশির ভাগ সবজি রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের কমপক্ষে এক সপ্তাহ পর তা বাজারে বিক্রির জন্য নিতে বলা হয়। তার আগে বাজারজাত করলে কীটনাশকের অবশেষ বা রেসিডিউ সবজিতে থেকে যায়।
এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে রাসায়নিক কীটনাশকের বিকল্প হয়েছে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা (আইপিএল) প্রযুক্তি ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া জৈব সারসহ অন্যান্য পরিবেশবান্ধব সার ব্যবহারের জন্য কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মঞ্জুরুল হাসান বলেন, যাঁরা জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে সবজি উৎপাদন করেন, তাঁদের খরচ একটু বেশি পড়ে, ফলে দামও বেশি হয়। প্রতিটি বাজারে তাঁদের পণ্য বিক্রির জন্য যদি একটি আলাদা ব্যবস্থা থাকে, তাহলে তাঁরা উৎসাহিত হবেন।
সুত্রঃ প্রথম আলো / কৃপ্র/ এম ইসলাম