কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ নতুন উদ্ভাবিত ১০ জাতের ধান নিয়ে উচ্ছ্বসিত ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, এর মাধ্যমে ধান ও চালের উৎপাদনে ঘটতে যাচ্ছে নতুন বিপ্লব। এসব ধানের মধ্যে কোনো কোনোটি আগে উদ্ভাবিত যেকোনো ধানের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় খরা সহনশীল, কোনোটি লবণাক্ততা সহনশীল; কোনোটি আবার সহ্য করতে পারবে বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। এমনকি একই সঙ্গে বন্যা ও লবণসহিষ্ণু ধানও উদ্ভাবিত হয়েছে এ বছর। আছে ভয়াবহ ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ও উচ্চমাত্রার জিংকযুক্ত ধান। কোনোটিতে আছে অন্য জাতগুলোর তুলনায় নতুন সুগন্ধি। উৎপাদন দেখে বিজ্ঞানীরাও অভিভূত। কোনো কোনো ধানের উৎপাদন তো হেক্টরপ্রতি ৯ টনও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম।
দেশের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত ৭৮টি জাতের ব্রি ধান উদ্ভাবন করেছেন। নতুন ১০টি জাত হলো তাঁদের সর্বশেষ সংযোজন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সরকারের কাছ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এবারই প্রথম নতুন জাতের এসব ধান চাষাবাদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আগেও কোনো কোনো জায়গায় মাঠে এসব জাত দেখা গেছে, তবে তা ছিল পরীক্ষামূলক চাষাবাদ। এবার সরাসরি চাষের জন্য লাগানো ধান আর কয়েক দিনের মধ্যেই কাটা শুরু হবে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘চলতি বছরে রিলিজ হওয়া চারটি নতুন জাতের ধানের ফলন দেখে সাধারণ কৃষকরা তো বিস্মিত হয়েছেই, আমরা বিজ্ঞানীরাও অভিভূত। কোথাও কোথাও ফলন তো পরীক্ষামূলক সময়ের চেয়েও ভালো হয়েছে। এর মধ্যে দুটি জাতের ধান সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর।’
ড. মো. শাহজাহান বলেন, ‘সর্বশেষ রিলিজ পাওয়া ব্রি-৭৮ জাতের আমন ধানটি একাধারে বন্যা ও লবণসহিষ্ণু। বাংলাদেশে এমন ধান এই প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছে। এর আগে আলাদাভাবে লবণাক্ততা বা বন্যা সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছিল। সে রকম দুই জাতের ধানের জিন একীভূত করে এবার ব্রি-৭৮ উদ্ভাবন করা হয়েছে। সরকারের অনুমোদনের পর এবার তা কৃষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ব্রি-৭৬ ও ব্রি-৭৭ হচ্ছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জোয়ার-ভাটা এলাকার উপযোগী দুটি জাত। এ জাতের ধানগাছের উচ্চতা ১৪০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। দেশে এ ধান উদ্ভাবনের জন্য অনেক আগে থেকেই চেষ্টা চলছিল, এবারই প্রথম আমরা সফল হয়েছি। এ দুটি জাতের ধান অন্য যেকোনো আমনের চেয়ে হেক্টরপ্রতি এক টন বেশি ফলন দেয়। ব্রি-৭৫-এর সাফল্যও অবাক করার মতো।’
নতুন উদ্ভাবিত বোরো জাতের হাইব্রিড-৫ ধানও এবার চাষের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওই কর্মকর্তা বলেন, জাতটি এখন পর্যন্ত দেশের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ ফলনশীল। হেক্টরপ্রতি এর ফলন সাড়ে আট থেকে ৯ টন পর্যন্ত হতে পারে; যা কেবল বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বেও বেশ বিরল।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘সাম্প্রতিক খরার মধ্যে উত্তরাঞ্চলে ব্রি-৭১-এর ফলন দেখতে গিয়েছিলাম। জমিতে গিয়ে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না এত ফলন কী করে হলো। কৃষকরাও অবাক।’
ব্রি ধান-৭১ চাষ করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষক মো. মহিবুল মিয়া। ফলন দেখে তিনিও উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, ‘আগত মুই আর কষ্টে থাকুম না, নতুন জাতের ধান পাইছি। খরাকালে জীবনভর কত মঙ্গায় থাকিল। এই এইটুকখানি ধানে খানিক সময়ের এমন ফলন হইল। হামাক এলাকার চাষিরা তো চোখত বিস্ময় দেখিল। কয়দিন বাদেই ধান কাটিমু। মনে হইল এইবার ধারদেনা আর থাকিব না।’
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রংপুরের আঞ্চলিক প্রধান ড. মো. শহিদুল ইসলাম বললেন, খরাপ্রবণ এলাকায় এখন আর আগের মতো মঙ্গার প্রভাব নেই। তবু এখানে খরায় চাষযোগ্য ফসল নিয়ে কৃষকদের মধ্যে উদ্বেগ ছিল। এ জন্য বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে খরা-সহায়ক ধান উদ্ভাবনে চেষ্টা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় এবার চমক নিয়ে এসেছে ব্রি ধান-৭১। এবারই প্রথম সাধারণ কৃষকদের জন্য এ ধানের চাষ উন্মুক্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে ছাড় পাওয়া ব্রি-৭৫ ধানটিও ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুরসহ বিভিন্ন খরাপ্রবণ এলাকায় ফলনে বেশ চমক দেখিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের অনেক কৃষক এখন প্রচলিত বিদেশি জাতের স্বর্ণা থেকে দেশে উদ্ভাবিত ধানের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে।
খুলনার কয়রার মতো লবণাক্ত এলাকায় চিংড়ি ঘেরের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ে ধানক্ষেত। নোনা পানির মাটিতে এমন ফলন সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কৃষক মোকসেদ গাজী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার নতুন বীজ আনিছে। তারা বলিছে এইটে ব্রি-৭৩ জাতের ধান। এখন তো দেইখেছি বেশ ভালোই ফলন ধইরেছে। খুব খুশি লাইগতেছে। লোনা মাটির মইধ্যে এমন ধান হতি পারে তা আগে কল্পনাও কইরতে পারিনি।’
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাতক্ষীরার আঞ্চলিক প্রধান ড. মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘ব্রি-৭৩ জাতের নতুন ধানের ৮০০ কেজি বীজ দিয়েছি চাষিদের মধ্যে। এতেই যে ফলন দেখছি, তা অবাক হওয়ার মতো। এবার কেবল সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটেও এ ধান দেওয়া হয়েছে। কৃষকরা সবাই এখনো এ ধান সম্পর্কে জানতে পারেনি। সামনে হয়তো এর আরো প্রসার ঘটবে।’
ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ধান : গাজীপুরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে সফল গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে মধ্যম পর্যায়ের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী ধান ব্রি-৭৪। বোরো জাতের এ ধান আধুনিক উফশী ধান। এ জাতের ধানের চাল দেখতে মাঝারি মোটা আকৃতির। ধানটির জীবনকাল ১৪৫ থেকে ১৪৭ দিন। এ জাতের ধানের চালে ৮.৩ শতাংশ প্রোটিন এবং প্রতি কেজি চালে ২৪ দশমিক ২ মিলিগ্রাম জিংক রয়েছে। প্রজনন পর্যায়ে ২১ থেকে ২৮ দিন বৃষ্টি না হলেও এর ক্ষতি নেই। প্রতি হেক্টরে এ ধান ৭ দশমিক ১ থেকে ৮ দশমিক ৩ টন পর্যন্ত ফলন দেয়। বীজ বপনের সময় ১৫-৩০ নভেম্বর।
সইতে পারবে লবণাক্ততা : ব্রি-৭৩ নামের আমন জাতের নতুন এ ধান লবণসহিষ্ণু ও অধিক ফলনশীল। চাল মাঝারি চিকন ও সাদা। ভাত হয় অন্য চালের চেয়ে ঝরঝরে। প্রতি হেক্টরে স্বাভাবিক ফলন হয় ৪ দশমিক ৫ টন। কম লবণাক্ত জমিতে এ ধান ৬ দশমিক ১ টন ফলনও দিতে পারে। এ জাতের ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রবও অনেক কম। এই জাতের বীজ বপনের সময় ১ থেকে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে। ধান কাটার সময় ১ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে।
হেক্টরপ্রতি উৎপাদন সাড়ে সাত টন : ব্রি-৭২ জাতটি বিআর ৭১৬৬-৩-৫-৩ ও বিআরআরআই ধান ৩৯-এর সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত। এটি একাধারে অধিক ফলনশীল ও জিংকসমৃদ্ধ আমন জাতের ধান। চালের আকৃতি লম্বা, মোটা ও সাদা। এ জাতের ধানের জীবনকাল ১২৫ থেকে ১৩০ দিন। স্বাভাবিক চাষাবাদের মাধ্যমে প্রতি হেক্টরে ৫ দশমিক ৭ টন এবং অধিকতর পরিচর্যার মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি সাড়ে সাত টন ধান পাওয়াও সম্ভব। বীজ বপনের সময় ২৫ জুন থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত। ধান কাটার সময় ১ থেকে ৩০ নভেম্বর।
খরায়ও টিকে থাকবে : ব্রি-৭১ জাতের ধানটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৩ সালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খরাপ্রবণ জমিতে চাষাবাদের মাধ্যমে এ জাতের আঞ্চলিক উপযোগিতা যাচাই করা হয়। এতে সফলতা পেয়ে সরকার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এ জাতের ধান দেখতে মাঝারি মোটা আকৃতির। জীবনকাল ১১৪ থেকে ১১৭ দিন। খরা সহনশীল জাতটি প্রজনন পর্যায়ে ২১ থেকে ২৮ দিন বৃষ্টি না হলেও টিকে থাকবে। অতি খরা বা মাটির আর্দ্রতা ২০ শতাংশের নিচে থাকলেও প্রতি হেক্টরে সাড়ে তিন টন, মধ্যম মানের খরায় চার টন এবং খরা না থাকলে পাঁচ থেকে ছয় টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যাবে। বীজ বপনের সময় ৫ থেকে ১৫ জুলাই, ধান পাকা ও কাটার সময় ১ থেকে ১৫ নভেম্বর।
সুগন্ধভরা : সুগন্ধি এ জাতের নাম ব্রি-৭০। আমন জাতের নতুন এ ধানের বৈশিষ্ট্য হলো এটি অধিক ফলনশীল, লম্বা, চিকন ও সুগন্ধি। রং সাদা। এটি প্রতি হেক্টরে ফলন হয় ৪ দশমিক ৮ টন। জীবনকাল ১৩০ দিন, যা অন্য সব ধানের চেয়ে ১০-১৫ দিন কম। স্বল্পমেয়াদি এ ধান কাটার পর সহজেই ওই জমিতে রবি শস্য আবাদ করা যায়। এ জাতের ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব অনেক কম। এ ধানের বীজ বপনের সময় ২৯ জুন থেকে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে। ধান কাটার সময় ১০ থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে।
তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী বেশি ফলনের পাশাপাশি এসব ধানে খাদ্যমান ও পুষ্টিগুণের দিকে আরো নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের পুষ্টি ও শস্য মান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী বলেন, সব ধানে খাদ্যমান ও পুষ্টিগুণ একই রকম থাকবে বা হবে, এটা বলা যায় না। একেক জাতের ধানে একেক মাত্রায় গুণাগুণ থাকে। তবে যেকোনো ধান উদ্ভাবনের জন্য গবেষণার সময় প্রয়োজনীয় মাত্রার গুণগত মান রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। যদিও অনেক সময় দেখা যায়, পরবর্তী সময়ে ওই মানের হেরফের ঘটে থাকে।
সুত্রঃ kalerkantho.com / কৃপ্র/ এম ইসলাম