‘৩০ ভাগ ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয় পোঁকামাকড়ের আক্রমনে’
আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ : প্রতিবছর সারা বিশ্বে গড়ে ৩০ ভাগ ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয় রোগজীবানু ও পোঁকামাকড়ের আক্রমনে । যদিও উন্নত বিশ্বের তুলনায় উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশসমূহে এ হার অনেক বেশী । সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর প্রচারনা এবং সহজলভ্যতার কারনে কৃষকরা ফসলে ব্যাপকভাবে রাসায়নিক কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছে । যার দরুন সৃষ্টি হয়েছে নানাবিধ জঠিলতা ।
এসব রাসায়নিক পদার্থসমূহ একদিকে পানি, বায়ু ও মাটি দূষিত করছে অন্যদিকে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে মানবদেহে ডুকে নানা রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে । পরিস্থিতি এতই নাজুক যে উন্নত বিশ্বে অতি ক্ষতিকর পেস্টিসাইডগুলো ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।এছাড়াও কৃষকদের ক্রমাগত নির্বিচারে রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহারের ফলে পোকামাকড়গুলো ধীরে ধীরে কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে পড়ে ।
আবার রাসায়নিক ছত্রাকনাশক ব্যবহারের ফলে জীবানু সমূহ নতুন রেস তৌরি করছে । ফলশ্র“তিতে এসব রাসায়নিক পেস্টিসাইডগুলো পোকমাকড় ও রোগজীবানুর বিরূদ্ধে আর কার্যকর থাকছে না । সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবনতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । তাই কৃষকদের রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার ফসলের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করলেও অনেক ক্ষেত্রে তেমন কোন কাজে আসছে না ।
তাই বিশ্বের সচেতন মানুষেরা এখন অর্গানিক কৃষির দিকে ঝুকে পড়েছে যেখানে কোন প্রকার রাসায়নিক পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয় না । বিজ্ঞানীদের সর্বোচ্চ মনযোগ এখন পরিবেশবান্ধব পেস্টিসাইড উদ্ভাবনের দিকে । এরকমই একটি পরিবেশবান্ধব বায়োফানজিসাইড হলো ট্রাইকোডারমা নামক উপকারী ছত্রাক । বিশ্বব্যাপি সমাদৃত এ বায়োফানজিসাইডটি অর্গানিক ফসল উৎপাদনে রোগ দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।
বায়োফানজিসাইড প্রকৃতি থেকে আহরিত এক প্রকার উপকারী ছত্রাক যা কৃষিজ উচ্ছিষ্টের উপর সহজে জন্মানো যায় । এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন শাক-সবজি, ডাল ও অন্যান্য শস্যের গোড়া পচা রোগ ও ঢলে পড়া রোগ সহজেই দমন করা যায় । বীজ শোধনের মাধ্যমে যে কোন ফসলের বীজবহিত রোগ দমন করা যায় । এ ছাড়াও বায়োফানজিসাইড দ্বারা বীজ শোধনের মাধ্যমে মাটিতে যেসব রোগের জীবানু থাকে যা বপনের পরে বীজকে আক্রমন করতে পাওে সেগুলোও স্বার্থকভাবে দমন করা যায় । যার দরুন মাটিবাহিত রোগ জীবানু বীজকে আক্রমন করতে পারে না । এর ফলে বীজ সুন্দরভাবে গজায়, চারা সুস্থ-সবল হয় এবং দ্রুত বেড়ে উঠে ।
এ বায়ো-পেস্টিসাইড ব্যবহার করলে পরিবেশের উপর বিরূপ কোন প্রতিক্রিয়া পড়ে না । এটি সরাসরি মাটিতেও ব্যবহার করা যায় । মাটিতে ব্যবহার করলে মাটি শোধিত হয় । শস্যের রোগ সৃষ্টিকারী জীবানু দমন হয় । এ ছাড়াও এ ধরনের পেষ্টিসাইড ব্যবহারে মাটিতে বিদ্যমান উপকারী জীবানুর ক্ষতি হয় না এবং মাটির গুনাগুন বৃদ্ধি পায় । বায়ুবাহিত রোগ-জীবানু দমনের জন্য এটি গাছেও স্পে করে প্রয়োগ করা যায় । জৈব সারের সাথে ব্যবহার করলে এটি একটিভেটর হিসাবে কাজ করে। এই বায়ো ফানজিসাইড মাটির গুনাগুন বৃদ্ধিসহ ক্ষতিকারক রোগের জীবানু ধ্বংস কর্ ে। ছত্রাক ছাড়াও মাটিবাহিত নেমাটোড দমনেও এটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে।
বায়ো-ফানজিসাইড ব্যবহারের উপকারীতা ঃ
১. বায়ো-ফানজিসাইড ব্যবহারের ফলে গাছের বৃদ্ধি হয় বেশী, রোগ হয় কম, মাঠে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ফলে উৎপাদনও হয় কয়েকগুন বেশী ।
২. পরিবেশ বান্ধব এই পেস্টিসাইড সহজেই দেশীয় মেশিনে স্বল্প খরচে উৎপাদন সম্ভব । এটি কৃষি উচ্ছিষ্টের উপর জন্মানো হয় বিধায় এর উৎপাদন খরচ একেবারেই অল্প যা কৃষিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম ।
৩. কৃষক ট্রেনিং নিয়ে সহজেই নিজ বাড়িতে এই বায়ো ফানজিসাইড উৎপাদন করতে পারবে এবং ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষন করতে পারবে।
৪. এটি ব্যবহার করা সহজ, পরিবেশ সম্মত এবং ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যের উপর কোন ঝুঁকি নেই।
রাসায়নিক কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর । এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্সে থাকার দরুন কৃষকরা নানাবিদ জঠিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে । মানব স্বাস্থ্য সংরক্ষনে অদুর ভবিষ্যতে এসব ক্ষতিকর পেস্টিসাইডগুলো নিষিদ্ধ করা হতে পারে । এ ব্যপারে উন্নত দেশসমূহে নীতিমালা তৌরি করা হচ্ছে । সেসব দেশে বানিজ্যিকভাবে ট্রাইকোডারমা উৎপাদন ও বিপনন করা হয় ।
স্বল্পব্যায়ী এবং সহজলভ্য এ বায়োফানজিসাইড একবার মাটিতে প্রয়োগ করলে দীর্ঘদিন যাবৎ কার্যকর থাকে । বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ এ বায়োফানজিসাইড নিয়ে গবেষনা হয়েছে । ফলাফলে দেখা যায় বাংলাদেশের আবহাওয়ায় ট্রাইকোডারমা নামক বায়োফানজিসাইডটি অত্যন্ত কার্যকর । বানিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে আবেদন করলেও এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়নি । মানব স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিবেশবান্ধব এ বায়োফানজিসাইডটি বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন ও প্রসারের জন্য সরকারের সুদৃষ্টি একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
কৃপ্র/ এম ইসলাম