এম.এ ওয়াদুদ মিয়া, শরীয়তপুর: শরীয়তপুরের কৃষকরা ধান চাষের পরিবর্তে মাছ চাষে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ফলে আশংকা জনক হারে কমে যাচ্ছে ফসলী জমি। সেই সাথে কমে যাচ্ছে খাদ্য উৎপাদন। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে জেলার খাদ্য উৎপাদন বিভাগ। আর ঝুঁকিতে রয়েছে জেলার খাদ্য নিরাপত্তা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ফসলী জমি রক্ষার জন্য কোন সুনির্দ্দিষ্ট আইন না থাকায় প্রশাসন কোন ভূমিকাই পালন করতে পারছে না। ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ফসলী জমি সুরক্ষায় সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন সুশীল সমাজ।
সরেজমিনে কয়েকজন কৃষকের সাথে আলাপ করতে গিয়ে জানা যায়, অধিকাংশ কৃষক এখন ফসলী জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষ করছে। বছরের পর বছর লোকসান হওয়ায় কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ধান উৎপাদনে যে পরিমান খরচ হয়, সে পরিমান লাভ না হওয়া এবং মাছ চাষে বেশী লাভ হওয়ার কারণে অনেক কৃষক কৃষি কাজ ছেড়ে এখন মাছ চাষ করছে। ফলে আশংকা জনক ভাবে কমে যাচ্ছে ফসলী জমি।
শরীয়তপুর জেলার ছয়টি উপজেলাই কম বেশী ফসলী জমি কেটে বড় বড় পুকুর করা হচ্ছে। যেখানে কৃষকরা মাছ চাষ করছে। এই চিত্র সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা গেছে সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু করে নড়িয়া উপজেলার সর্বত্র। এ ছাড়া ডামুড্যা, ভেদরগঞ্জ এবং গোসাইরহাট উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জমি কেটে মাছের প্রজেক্ট তৈরী করা হচ্ছে। বেশীরভাগ প্রজেক্টের পরিচালনায়ই রয়েছে স্থানীয় যুবক শ্রেনীর লোকেরা। তারা সমবায়ের ভিত্তিতে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
তবে জাজিরা উপজেলায় এর পরিমান তুলনামূলক ভাবে খুবই কম। নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের মান্ডা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে ঐ গ্রামের বাসিন্দা চপল মোল্যা, হালিম মোল্যাদের বংশের মোট ১১জন মিলে অন্তত ১ শত ১০ বিঘা জমি নিয়ে একটি বিশাল দিঘী খনন করে সেখানে মাছের খামার করছে। যে জমিতে চলতি মৌসুমেও বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছিল।
বিগত ৬/৭ বছর ধরে ধানসহ বিভিন্ন ধরণের ফসল চাষাবাদ করে কৃষক বরাবরই লোকসানে পরার কারণে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ফসল উৎপাদনে। তাই মাছ চাষ অধিক লাভবান হওয়ায় তারা ঝুঁকে পড়ছে এই ব্যবসায়। ফলে, আশংকা জনক ভাবে হ্রাস পাচ্ছে জেলার ফসলী জমি। আর এ কাজে জেলা মৎস বিভাগও উৎসাহ দিচ্ছে মাছ চাষীদের। তারা মনে করেন, মৎস চাষ কৃষিরই একটা অংশ। একই জমিতে ফসল আবাদ না করে মাছ চাষ করা কৃষির সাথে কোন সাংঘর্ষিক কিছু না।
শরীয়তপুর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে জেলায় যে পরিমান ফসলী জমি ছিল, মৎস্য চাষ করার কারণে তার থেকে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি কমে গেছে। ইতিপূর্বে নদী ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে যে পরিমান ফসলী জমি নষ্ট হয়েছে, তার চেয়ে বেশী ফসলী জমি নষ্ট হয়েছে ফসলী জমি কেটে মাছ চাষ করায়। ২০০৫ সালে জেলার ফসলী জমির পরিমান ছিল ৯৫ হাজার হেক্টর। ৭ বছর পর ২০১২ সালে তা কমে এর পরিমান দাড়িয়েছে ৯৩ হাজার হেক্টরে। শুধুমাত্র ফসলী জমিতে মৎস্য প্রকল্প করার কারণে ৩ বছরের ব্যবধানে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত শরীয়তপুরের ফসলী জমির পরিমান কমে এসে দাড়িয়েছে ৯০ হাজার ২০ হেক্টরে। যার ফলে জেলার খাদ্য উৎপাদনও কমে যাচ্ছে।
এ বছর জেলায় খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। তার মধ্যে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার মেট্্িরক টন চাউল এবং ১৭ মেট্্িরক টন গম রয়েছে। এখন মাছ চাষের জন্য যে পরিমান ফসলী জমি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা যদি জরুরী ভিত্তিতে রক্ষা করা না হয়, তাহলে অচিরেই জেলার খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে আশংকা করছেন খোদ জেলার প্রধান কৃষি কর্মকর্তা।
জেলার আচুড়া, আনাখন্ড, দুলুখন্ড, মান্ডা, ধামারন, ফতেজঙ্গপুর, ভোজেশ্বর এবং জপসা এলাকার জমির মালিক আবুল হোসেন মোল্যা, লোকমান হোসেন, সজীব খান, মজিবুর রহমান, সামছুল হক মুন্সি, আব্দুল হান্নান, চপল মোল্যা এবং জিল্লুর রহমান জানিয়েছেন, আমাদের বংশ পরম্পরায় এই সকল জমিতে ধানসহ বিভিন্ন মৌসুমী ফসল আবাদ করা হতো। গত কয়েক বছর ধান চাষে লোকসান হওয়ার কারণেই আমরা ফসল উৎপাদন না করে মাছের চাষ করছি। এতে আমরা অনেক বেশী লাভবান হচ্ছি।
শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আব্দুস সালাম বলেন, ধান উৎপাদন করা থেকে মাছ চাষে অধিক লাভ হওয়ায় শরীয়তপুরের কৃষকরা ধান চাষ করা বাদ দিয়ে দিয়েছে। এখন তারা সেখানে পুকুর কেটে মাছ চাষ করছে। এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে যে লাভ হয়, তার থেকে ৩ থেকে ৪ গুন বেশী লাভ হয় মাছ করে। তাই কৃষকরা ফসলী জমিতে নতুন নতুন পুকুর খনন করে মাছ চাষ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটা কৃষির সাথে কোন বিরোধ নয়, মাছ চাষ কৃষিরই একটি অংশ। আমি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি, আধুনিক মৎস চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে তাদের প্রয়োজনীয় কারিগরী সহায়তা এবং পরামর্শ প্রদানের জন্য।
শরীয়তপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ কবির হোসেন বলেন, কৃষি জমি সুরক্ষায় সুনির্দ্দিষ্ট কোন আইন না থাকায়, ফসলী জমিতে মাছ চাষ করে কৃষি জমি ধ্বংস করা হচ্ছে। এভাবে আবাদী জমি কমে যেতে থাকলে জেলার খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, কৃষি জমি রক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোন আইন না থাকায়, ফসলী জমি ধ্বংস করে মৎস্য চাষ করাকে বাঁধাগ্রস্থ করার কোন সুযোগ নেই।
কৃপ্র/ এম ইসলাম