রফিকুজ্জামান লায়েক : পাট আমাদের বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। আমাদের দেশের ভূমি এবং জলবায়ু পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। দুনিয়া ব্যাপী দুই জাতের পাটের চাষ হয়ে থাকে। তার মধ্যে দেশি পাটের উৎপত্তি আমাদের দেশে আর তোষা পাটের উৎপত্তি আফ্রিকা মহাদেশে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নতমানের দেশি ও তোষা পাট আমাদের দেশেই উৎপন্ন হয়ে থাকে। পাট তন্তু জাতীয় উদ্ভিদ। পাট গাছের ছাল থেকে পাটের আঁশ সংগ্রহ করা হয়। পাট আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশে দুইশত বছরের ও আগের থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশে পাট অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। যদিও বর্তমানের রাষ্ট্র ও সমাজকর্তারা তা স্বীকার করতে চান না। পাট বিক্রির বাড়তি অর্থ দিয়েই এ ভূখণ্ডে কৃষক তার সন্তানকে শ্লেট, পেন্সিল সহ শিক্ষা সামগ্রী কিনে দিতে শুরু করেন। নানাভাবে পাট ও পাট শিল্পকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে, যার ফলে আমাদের সমাজ বিকাশে পাটের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
এক সময় প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে পাট খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হত। রপ্তানি আয়ের একটি ভাল অংশ এখনও পাট খাত থেকে এসে থাকে। পাট থেকে সুতা সহ অন্যান্য পাট সামগ্রী উৎপাদন হয়ে তাকে। গড়ে বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করে ৩২ লাখ মেট্রিকটন পাট উৎপাদন হয়ে থাকে। যার শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি অর্থাৎ ৮.৩৩ লাখ মেট্রিকটন বা পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ২৬.০২ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদন হয়ে থাকে। পাটের রং সোনালী এবং পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয় বিধায় পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয়ে থাকে।
আমাদের দেশের পাটের বাজারকে কেন্দ্র করে ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জে গড়ে উঠেছিল আদমজী পাট কলের মত বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৬টি সরকারি ও ৭৬টি বেসরকারি পাট কল রয়েছে। যদিও সবগুলিতে এখন উৎপাদন হয় না। আবার কলগুলি পুরোনো হওয়ার কাক্সিক্ষত উৎপাদন পাওয়া যায় না। ফলে উৎপাদন খরচ বেশি হয়। যার ফলে মিলগুলিতে লোকসান হয়ে থাকে। পাট ও পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও বিকাশের জন্য যে পরিমাণে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন আমাদের রাষ্ট্র তা করছে না। তুলার সঙ্গে পাটের আঁশ ব্যবহার করে চীনের মত কাপড় উৎপাদন করতে পারলে একদিকে তুলার আমদানি হ্রাস পেত, অন্যদিকে পাটের ব্যবহারও বৃদ্ধি পেত। ফলে কৃষক ভাল দাম পেত এবং তুলা আমদানি কমে যাবার কারণে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হত।
স্বাধীনতার পর থেকে পাটের দাম উঠা-নামা করার মধ্য দিয়ে চলছে। তবে পাট চাষি তার কাক্সিক্ষত লাভজনক দাম পাচ্ছেন না অনেক বছর ধরে। দেশের স্বার্থে পাট শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পাট চাষিদের স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। চাষিদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। পাট চাষিদের স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার যে, উৎপাদন করতে যে সকল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তার প্রতিকার করা। বিদেশে কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানি কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন পাট চাষি ও পাট শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক, কর্মচারী ও ছোট ব্যবসায়ীরা।
আমাদের দেশের রপ্তানিকৃত কাঁচা পাটের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ রপ্তানি হয় ভারত, চীন ও পাকিস্তানে। এছাড়া থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল ও আইভরিকোস্টে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কাঁচা পাট রপ্তানি হয়ে থাকে। পাটজাত পণ্যের মধ্যে অর্ধেক রপ্তানি হয় হল পাটের সুতা। আমাদের দেশের পাটের সুতার প্রধান বাজার হল তুরস্ক। চীন, ভারত, ইরান, মিশর, ইন্দোনেশিয়া ও বেলজিয়ামে সূতা রপ্তানি হলেও মোট রপ্তানির ৪০ শতাংশ যায় তুরস্কে। গৃহযুদ্ধের কারণে মিশরে রপ্তানি অনেক কমে গেছে।
একটি কথা সমাজে বেশ ভালভাবেই প্রচলিত আছে যে, যার দাম একবার বাড়ে, তার দাম আর কমে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে কৃষকের বেলায় এ-কথাটি অর্ধসত্য। কেন না কৃষি উপকরণের দাম বাড়লে আর কমে না। তবে কৃষি ফসলের দাম যে কোন সময়ে কমে যেতে পারে।
পচনশীল খাদ্য দ্রব্যের বিষয়টা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু পাটের বেলায়…? ২০১১ সালে প্রতি মণ পাট ২৫০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। তারপর তো আরও ৫/৬টি বছর চলে গেল। ঐ দামে আর পাট বিক্রি করা হল না পাট চাষিদের। ঠেলায় পড়ে নির্বাচনী ওয়াদা ঠিক রাখতে যেয়ে সরকার পাট শিল্পের জন্য লোক দেখানো কিছু ভাল সিদ্ধান্ত নেয়াতে পাটের বাজারটা ভাল হয়েছিল। কিন্তু তারপর যা তাই। দেমের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাট চাষের সাথে জড়িত। কৃষক-ক্ষেতমজুর সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত। পাট বিপণন ও কাঁচা পাট ব্যবহার উপযোগী করে ‘পাট পণ্যে’ পরিণত করতে নানান স্তরে বহুলোকের প্রয়োজন হয়।
পাট ও পাট শিল্পের বিকাশের পথে বাঁধা রয়েছে অনেক। প্রথমত, সরকারের উদাসীনতা বা অবহেলা। গত কয়েকটি সরকার ব্যক্তিখাতকে প্রাধান্য দিলেও ব্যক্তিখাতের বৃহত্তর খাত হল কৃষি। কিন্তু এদিকে নজর নেই। কারণ এখানে কমিশন কম। দ্বিতীয়ত, বিদেশি ষড়যন্ত্র। যে বিশ্ব ব্যাংকের ব্যবস্থাপত্রের দ্বারা আদমজী পাটকল বন্ধ করা হয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একই সময়ে ভারতে নতুন পাটকল স্থাপিত হয়েছিল।
লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ করা হয়েছিল এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটি। অথচ আদমজী পাটকল বন্ধ করতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যে টাকা খরচ করা হয়েছিল, তার থেকে অনেক কম টাকা দিয়ে পাটকলটি বিএমআরআই করালে লোকসান না হয়ে বরং লাভ হত। পাটখাত সংস্কার কর্মসূচির নামে বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পাটকলগুলি বন্ধ করে। এতে পাটচাষি ও পাটকল শ্রমিকদের স্বার্থের পরিপন্থি এবং পরিবেশের পরিপন্থি কাজ করা হয়েছে। তৃতীয়ত, পাট ও পাট শিল্পের অন্তরায় হল পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার। নাগরিক সচেতনতা এর জন্য দায়ী।
পাটের বদলে আমরা প্রত্যহ যা ব্যবহার করছি, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং তা আমরা করছি জেনেশুনেই। বাংলাদেশের নগর জীবন থেকে শুরু করে সর্বত্র পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের কারণে পরিবেশ-প্রকৃতি মারাত্মকভাবে হুমকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় শহরগুলির আশ-পাশের নদীর তলদেশ পলিথিন দ্বারা ভরাট হয়ে চলছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ছে। ফসলের মাঠে ঢুকে পড়ছে পলিথিন। পলিথিন পচে মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে ৪ শত বছরেরও বেশি সময়। তারপরেও জেনেশুনে কেন আমরা ক্ষতিকর পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। তার কারণ হল- বর্তমানে পলিথিন যত সহজে ও সস্তায় পাওয়া যায়, পাটের ব্যাগ ও বস্তা তত সস্তায় পাওয়া যায় না। কিন্তু পাটের দামের সাথে পাটজাত পণ্যের দামের কোন সামঞ্জস্য নেই। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মান ভেদে ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা দরে প্রতিমণ পাট বিক্রি হচ্ছে। অথচ ৫০০-৮০০ গ্রামের ১টি পাটের বস্তার দাম ৬০ টাকা। সরকারি মিলগুলিতে পুরনো যন্ত্রপাতির কারণে উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে আর বেসরকারি খাতের মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে। কারও কোন জবাবদিহিতার বালাই নেই।
২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর ৩ জুলাই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক মুক্ত দিবস পালন করা হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকা সময়ে ২০০২ সালে পলিথিন উৎপাদন ও বিপণনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অল্পদিনের মধ্যে তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। বর্তমান জোট সরকার ৬টি পণ্য– ধান, গম, চাল, ভুট্টা, সার ও চিনি মোড়কীকরণে পাটের বস্তার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। প্রথমদিকে কর্তা ব্যক্তিদের কিছু দৌড়ঝাপ লক্ষ্য করা গেলেও এখন আর তা হচ্ছে না। ফলে আগের সরকারের আদেশের মত এ সরকারের আদেশও অনেকটা একই রকমের।
আইন কার্যকর করার জন্য প্রথমদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ লক্ষ্য করা গেলেও এখন আর তা তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের নানামুখী উদ্যোগ ও জনগণের সচেতন প্রয়াসের মাধ্যমে পলিথিন বর্জনের আন্দোলন সফল হতে পারে। ক্ষতিকর এই পলিথিনের ব্যবহার আমাদের দেশে ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হয়। পলিথিন রাসায়নিকভাবে পলিমার জাতীয় পদার্থ থেকে তৈরি। পাট ও পাট শিল্পকে বাঁচাতে হলে পরিবেশ-প্রকৃতি ঠিক রাখতে হলে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন।
পাটের বস্তার সামান্য ব্যবহার বাড়ার কারণে– সীমিতভাবে হলেও মিলগুলিতে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। পাট আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। পাটের জীবন রহস্য আমাদের দেশের বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন। দুনিয়া ব্যাপী পরিবেশবাদীরা প্লাস্টিক দ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। সকল দেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষার জন্য লড়াই করছেন। পাট চাষ ও পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন ও বিপণনের সাথে কোটি কোটি মানুষ জড়িত রয়েছে শত বছরেরও আগের থেকে। পাটের অর্থনৈতিক গুরুত্বের সাথে সাথে তার রয়েছে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বও।
পাটের বাজারগুলিতে সিজনে পাট প্যাকিং করার সময়ে অঞ্চল ভেদে নানা ধরনের জারি-সারি ও আঞ্চরিক গানও গাইতে দেখা যায়–যা পল্লীর অকৃত্রিম প্রকৃতির সঙ্গে মিশে নিজের স্বরুপকেই চেনাতে প্রয়াস পায়। পাট ও পাট শিল্পের যে সম্ভাবনা আমাদের দেশে রয়েছে, তাকে আগাতে হলে দায়িত্ব সচেতন মহলসহ কৃষক সংগঠনসমূহকে আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা হাজার হাজার পলিথিনের কারখানার মালিক দেশের শাসক শ্রেণি। তারা সহজে হার মানবে না। তবে লড়াই করেই এবং দেশি-বিদেশি শাসক ও স্বার্থবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পাট ও পাট শিল্পের সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক : সভাপতি ফরিদপুর জেলা কমিটি, সিপিবি
কৃপ্র/ এম ইসলাম