কৃষিবিদ মো. আবু সায়েম: রবি মৌসুমে প্রায় সারা দেশে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে ঘন কুয়াশা ও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আবহাওয়া প্রবাহিত হয়ে থাকে। প্রতিবছরই বোরো বীজতলাসহ বিভিন্ন মাঠ ফসল ঠা-াজনিত আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। প্রচ- ঠা-া ও ঘন কুয়াশার কবল থেকে বোরো বীজতলাসহ বিভিন্ন মাঠ ফসল রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়ে। প্রচলিত কিছু পদ্ধতি ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি উভয়ই মিলিয়ে সহজেই সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে ফসল রক্ষা করা যায় এবং অধিক ফলন নিশ্চিত করা সম্ভব।
বোরো ফসল : বীজতলায় এক থেকে দুই ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে এবং স্বচ্ছ পলিথিনের ছাউনি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখা দরকার। শৈত্যপ্রবাহের সময় বীজতলা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে সকাল ১০-১১টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হবে। বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে আবার নতুন পানি দিলে, প্রতিদিন সকালে রশি টানা দিয়ে চারা থেকে কুয়াশার পানি ফেলে দিলে চারা শীত থেকে রক্ষা পায় এবং ভালোভাবে বাড়তে পারে। ঠা-ার কারণে চারায় ধসেপড়া রোগ দেখা দিলে বীজতলা থেকে পানি সরিয়ে দিতে হবে এবং বীজতলায় প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম পটাশ সার প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপণের সময় শৈত্যপ্রবাহ থাকলে কয়েকদিন দেরি করে চারা রোপণ করুন। রোপণের জন্য কমপক্ষে ৩৫-৪৫ দিনের চারা ব্যবহার করতে হবে। এ বয়সের চারা রোপণ করলে শীতে চারা কম মারা যায়, চারা সতেজ থাকে এবং ফলন বেশি হয়। থোড় ও ফুল ফোটার সময় অতিরিক্ত ঠা-া আবহাওয়া থাকলে জমিতে ২-৩ ইঞ্চি পানি ধরে রাখলে থোড় সহজে বের হয় এবং চিটার পরিমাণ কম হয়। ঠা-া সহনশীল জাত যেমন-ব্রি ধান৩৬, ব্রি ধান৫৫ চাষ করলে বেশি ঠা-ায় চারা কম মারা যায়।
আলু ও টমেটো : ঘন কুয়াশার কারণে আলু ও টমেটো ফসলে লেইট বস্নাইট (মড়ক রোগ) রোগের আক্রমণ হতে পারে। এ ধরনের আবহাওয়ায় আলু ও টমেটো ফসলে প্রতিরোধক হিসেবে বর্দোমিকচার অথবা মেনকোজেবজাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে সাতদিন পর পর স্প্রে করতে হবে। এ রোগের আক্রমণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিচাপা দিতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং জমিতে সেচ দেয়া বন্ধ রাখতে হবে। এ ছাড়া প্রতি লিটার পানিতে সিকিউর এক গ্রাম মেলোডিও দুই গ্রাম হারে মিশিয়ে সাত থেকে ১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে।
সরিষা ও শিম : সরিষা ও শিমগাছে জাবপোকার আক্রমণ দেখা দিলে আঠাযুক্ত হলুদ ফাঁদ অথবা আধাভাঙ্গা নিমবীজের পানি (এক লিটার পানিতে ৫০ গ্রাম নিমবীজ ভেঙে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে নিতে হবে) আক্রান্ত গাছে ৭-১০ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। তবে আক্রমণের মাত্রা খুব বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে অ্যাডমায়ার/টিডো/অ্যামিটাফ ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আমের মুকুল : ঘন কুয়াশার কারণে আমগাছের মুকুল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এরূপ আবহাওয়ায় আমগাছে প্রতিরোধক হিসেবে বর্দোমিকচার অথবা সালফারঘটিত ছত্রাকনাশক যেমন-থিওভিট ৮০ ডাবিস্নউজি প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া এরূপ আবহাওয়ায় শোষক পোকার (হপার) বংশ দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে পারে তাই গাছের কা-ে ও পাতায় সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি বা ল্যামডা সাই হ্যালাথ্রিন ২.৫ ইসি বা ফেন ভেলোরেট ২০ ইসি গ্রুপের যে কোনো কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে এক মিলি হারে স্প্রে করতে হবে।
পানের পাতা ঝরা রোধ : তীব্র শীতের কারণে অনেক সময় পানের পাতা ঝরে যেতে পারে। পানের বরজের চারপাশে বিশেষ করে উত্তরে পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিলে তীব্র শীতের হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
সুপারি ও নারিকেলের পাতাপড়া রোধ : তীব্র শীতের কারণে অনেক সময় নারিকেল-সুপারির পাতা পুড়ে যেতে পারে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহকালে সেচের পানি বা হালকা গরম পানি স্প্রে করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে গাছে নিয়মিত সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ করলে গাছপালা সুস্থ সবল থাকে এবং যে কোনো খারাপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। সর্বোপরি, রবি মৌসুমের বিভিন্ন ফসল উৎপাদনে ডিএপিসহ অন্যান্য রাসায়নিক সার সুষম মাত্রায় ব্যবহার করলে বেশি ঠা-া থেকে ফসল রক্ষা পায় এবং ফলন বেশি পাওয়া যায়।
লেখক : আঞ্চলিক বেতার কৃষি অফিসার, কৃষি তথ্য সার্ভিস , আঞ্চলিক অফিস, রংপুর