কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উদ্ভাবন করেছে ধানের ৮১টি জাত। যদিও এসব জাতের কমসংখ্যকই কৃষক পর্যায়ে আবাদ হচ্ছে। দেশে ধান আবাদের ৫৭ শতাংশই হচ্ছে পাঁচটি জাতের। আর এ পাঁচ জাতের ওপর নির্ভরশীল ৬৫ শতাংশ কৃষক। বাংলাদেশের কৃষিতে কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছে ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই)। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘চেঞ্জিং সিনারিও অব বাংলাদেশ এগ্রিকালচার’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় বিআর ২৮ জাতের ধান। ২০ শতাংশ জমিতে ধানটির আবাদ হচ্ছে। জাতটি আবাদ করছেন দেশের প্রায় ৩৬ শতাংশ কৃষক। এরপর সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে গুটি বা স্বর্ণা ধান। এ জাতের ধান আবাদ হচ্ছে ১৫ শতাংশ জমিতে। আর ধানটি আবাদ করছেন ২৪ শতাংশ কৃষক। বিআর ২৯ ধানের আবাদ হচ্ছে ১৪ শতাংশ জমিতে। ব্রি উদ্ভাবিত জাতটি আবাদ করছেন দেশের ২০ শতাংশ কৃষক। অন্যদিকে মুক্তা বা বিআর ১১ ধানের আবাদ হচ্ছে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ জমিতে এবং জাতটি আবাদ করছেন ১০ শতাংশ কৃষক। এছাড়া ৩ শতাংশ জামিতে আবাদ হচ্ছে পাইজাম বা বিআর ২৫ ধানের। জাতটি আবাদ করছেন প্রায় ৬ শতাংশ কৃষক।
গুটিকয় জাতের মধ্যে ধানের আবাদ সীমাবদ্ধ থাকার কারণ হিসেবে উদ্ভাবিত সব জাত কৃষকের কাছে না পৌঁছানোকে দায়ী করছেন অনেকে। পাশাপাশি বেশকিছু জাতের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকগুলো জাত উচ্চফলন দিলেও সেগুলোর চালের মান সন্তোষজনক নয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত এসব জাতের বীজ বিপণনে নিয়োজিত বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। সংস্থাটি বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা থাকায় প্রথাগত জাতের ধানবীজ বিক্রির মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চেষ্টা করে। ফলে নতুন আসা বীজগুলো কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। বীজ সংকটের কারণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) মাঠ পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সম্প্রসারণ করতে পারছে না। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাধ্যমেও উদ্ভাবিত এসব জাত কৃষকদের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না।
ধানের জাতের সঠিক ও কার্যকর ব্যবহার করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্রির মহাপরিচালক (এলপিআর) ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, উদ্ভাবিত এসব জাতের গুণগত মান ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও কৃষকের চাহিদার দিক বিবেচনায় নিয়েই নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এগুলো মাঠপর্যায়ে সফলভাবে উত্পাদনের পরই কৃষক পর্যায়ে ছাড়া হচ্ছে। কিন্তু বিপণন ও সম্প্রসারণ পর্যায়ে উদ্ভাবিত এসব জাতের গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে না। ফলে কৃষকরা প্রথাগত কয়েকটি জাতের মাধ্যমেই ধান আবাদ করছেন। এটা কাটিয়ে উঠতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বিএডিসিকেও।
ব্রি উদ্ভাবিত গুরুত্বপূর্ণ একটি জাত ব্রি ধান ৫৮। স্বল্পমেয়াদি জাতটি উচ্চফলন দিতে যেমন সক্ষম, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও অনকূল। দেশে প্রথমবারের মতো টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উদ্ভাবন করা হয়েছে বোরো মৌসুমের জাতটি, যা ব্রি ধান ২৯-এর মতোই। তবে উত্পাদনক্ষমতা এর চেয়েও বেশি। বোরো মৌসুমে চাষ উপযোগী জাতটি ব্রি ২৯-এর চেয়ে সাতদিন আগেই অর্থাত্ ১৫০-১৫৫ দিনে কাটা যায়। ফলনও হয় প্রতি হেক্টরে সাত-সাড়ে সাত টন। আর ব্রি ২৮-এর চেয়ে জাতটির জীবত্কাল ছয়-সাতদিন নাবি। ব্রি ৫৮ মাঝারি ঢলে পড়া প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, যা ব্রি ২৮-এর নেই। তার পরও কৃষকদের জাতটিতে আগ্রহী করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে জাতটির উদ্ভাবক ব্রির মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের প্রধান ড. তমাল লতা আদিত্য বলেন, পরিপক্ব হতে বেশি সময় নেয়া ও বাড়তি সেচের কারণে ব্রি ২৮ ও ২৯-এর বিকল্প জাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন কৃষক। আবার জাত দুটির ফলন বেশি হওয়ায় এ থেকে সরতে চাইছিলেন না তারা। বিষয়টি অনুধাবন করে বিজ্ঞানীরা নতুন জাত উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করেন। দীর্ঘ ১২ বছরের গবেষণার ফসল ব্রি ধান ৫৮। জাতটি উদ্ভাবনে প্রথমে ব্রি ২৯-এর চাল থেকে ল্যাবরেটরিতে টিস্যু কালচার পদ্ধতির সহায়তা নেয়া হয়েছে। এরপর গ্রিনহাউজে স্থানান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। এ বীজ বর্ধন করে বৃহত্ পরিসরে জন্মানো হয়েছে। তাই জাতটি অবমুক্তির পর প্রায় প্রতিটি জেলায় প্রদর্শনী প্লটের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে ফলাফল পার্থক্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল ধানের চাষাবাদ করা হয়। এছাড়া দেশের মোট ধানের প্রায় ৯০ শতাংশই আসছে ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল জাত থেকে। তবে মূলত পাঁচটি জাতের মধ্যেই আবাদ সীমিত রেখেছেন কৃষক। ডিএইর সরেজমিন বিভাগের পরিচালক কৃষিবিদ চৈতন্য কুমার দাস বলেন, সতর্কতার সঙ্গে দেশের প্রতিটি জেলায় উদ্ভাবিত প্রায় সব জাতের প্রদর্শনী ও আবাদের মাধ্যমে কৃষককে উত্সাহিত করা হচ্ছে।
কৃপ্র/ এম ইসলাম