কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ এনজিও থেকে ঋণসহায়তা পান না ক্ষুদ্র কৃষক। ব্যাংকঋণেও পিছিয়ে। এমনকি যোগাযোগ দক্ষতায় ঘাটতির কারণে সরকারি ভর্তুকি সহায়তাও ঠিকমতো পৌঁছে না। অথচ বঞ্চিত এসব কৃষকই উৎপাদন করছেন মোট ধানের অর্ধেক। ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে মোট উৎপাদিত ধানের ৫০ শতাংশই আসে ক্ষুদ্র কৃষকের কাছ থেকে। তিন দশক আগে ১৯৮৮ সালে এক্ষেত্রে তাদের অবদান ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
‘স্ট্র্যাটেজিক এগ্রিকালচার সেক্টর অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি ডায়াগনস্টিক ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় এক একর বা ১০০ শতক পর্যন্ত জমি রয়েছে, এমন কৃষককে ক্ষুদ্র কৃষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত কয়েক দশকে খামারের আয়তন ছোট হয়ে আসায় উৎপাদন পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে।
ধান উৎপাদনে বড় অবদান রাখলেও বিপণনে এখনো পিছিয়ে রয়েছেন ক্ষুদ্র কৃষকরা। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ মাঝারি কৃষকদের হাতে। গবেষণার তথ্যমতে, বাজারে বিক্রি হওয়া মোট ধানের প্রায় অর্ধেক আসে মোট খানার ১৩ শতাংশের কাছ থেকে, যারা প্রায় আড়াই একর জমির মালিক। আর বাজারজাতকৃত মোট ধানের এক-তৃতীয়াংশ আসে তিন-চতুর্থাংশ ক্ষুদ্র খানা থেকে, যাদের জমির পরিমাণ এক একর পর্যন্ত। তবে ক্রমেই এ ধরনের কৃষকের বাজারমুখিতা বাড়ছে। উৎপাদন ও ভোগ ঘাটতির পরও ক্ষুদ্র চাষীরা বাজারে ধান বিক্রি করছেন। পরবর্তীতে বাজার থেকে চাল কিনে নিজেদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করছেন। রয়েছে দক্ষতার সংকটও। মোট ধান বা চাল উৎপাদনে নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সময়ের সঙ্গে ক্ষুদ্র কৃষকদের দক্ষতা কমছে। মূলত উপকরণ ব্যয় তুলনামূলক বেড়ে যাওয়ায় এ ধরনের কৃষকরা নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে পারছে না বলে মন্তব্য করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
কয়েক দশক ধরেই বাংলাদেশের কৃষি খাতের গতি-প্রকৃতি ও সমস্যা নির্ণয়ে কাজ করছে ব্র্যাক। এরই অংশ হিসেবে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। এক্ষেত্রে দেশের ৬২টি গ্রামের ওপর পরিচালিত খানা জরিপ উপাত্তের ভিত্তিতে তৈরি ২০০৪ ও ২০১৪ সালের তথ্য এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) টাইম সিরিজের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে সংস্থাটি। গবেষণা প্রতিবেদনের ১০টি অধ্যায়ে বাংলাদেশের কৃষি খাতের বিভিন্ন শাখা এবং সমস্যা ও সম্ভাবনা তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি আপেক্ষিক সুবিধা, বাণিজ্যিকীকরণ ও ভ্যালু চেইন শীর্ষক অধ্যায়ে ধান উৎপাদন ও বিপণনে ক্ষুদ্র কৃষকের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণার শুরুতে নেতৃত্বে ছিলেন ব্র্যাকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহাবুব হোসেন। তার মৃত্যুর পর গবেষণাটি সম্পন্ন করেন ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েস। এ কার্যক্রমে পরামর্শক হিসেবে ছিলেন ড. ফখরুল ইসলাম।
অধ্যাপক আবদুল বায়েস বণিক বার্তাকে বলেন, খাদ্য উৎপাদন ধরে রাখাসহ সামগ্রিক কৃষির হাল ধরছেন ক্ষুদ্র কৃষক। তবে ক্ষুদ্রঋণসহ ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে এসব কৃষক অর্থায়ন সুবিধা পাচ্ছেন না। আবার প্রযুক্তিগত ও সরকারি সহায়তাগুলো থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। নিজস্ব প্রচেষ্টায় উৎপাদন করে যাচ্ছেন তারা।
তিনি বলেন, এ অবস্থা ধরে রাখতে ক্ষুদ্র কৃষকদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াতে প্রযুক্তিগত সুবিধা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি আর্থিক কার্যক্রম ও সরকারের উপকরণ সহায়তা কার্যক্রমে এদের দক্ষভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এছাড়া চালনির্ভর অবকাঠামো ও প্রণোদনা থেকে চালবহির্ভূত ফসল উৎপাদনে গবেষণা, সম্প্রসারণ ও প্রণোদনা বাড়াতে হবে। না হলে সামনের দিনে এটি আর ধরে রাখা যাবে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৪ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়। সাম্প্রতিক গবেষণার হিসাবে এর মধ্যে ১ কোটি ৭৭ লাখ টনই উৎপাদন করেছেন ক্ষুদ্র কৃষক। উৎপাদনে ক্ষুদ্র কৃষকের অবদান বাড়লেও সরকারি বিভিন্ন সুবিধা থেকে এখনো তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রতি বছরই উচ্চ উৎপাদন ব্যয় নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। উৎপাদন ব্যয় কমাতে সরকারের দেয়া বিভিন্ন ভর্তুকির কার্যকারিতাও এক্ষেত্রে খুব কম। মূলত প্রথাগত সুবিধাভোগী নির্বাচন পদ্ধতির কারণেই ভর্তুকি সুবিধা থেকে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। ফলে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়, যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে বিপণন পর্যায়ে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রপস রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর দ্য সেমি-অ্যারিড ট্রপিকসের (আইসিআরআইএসটি) ‘এগ্রিকালচার ট্রান্সফরমেশন ইন বাংলাদেশ: এক্সটেন্ড, ড্রাইভারস অ্যান্ড ইমপ্লিকেশন্স’ শীর্ষক আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, এক হেক্টর জমিতে সেচ দিতে ভারতে ব্যয় হয় প্রায় ৪০ দশমিক ৮ ডলার। বাংলাদেশে সমপরিমাণ জমিতে সেচের জন্য ব্যয় হয় ১২৪ দশমিক ৬ ডলার। একই অবস্থা সারের ক্ষেত্রেও। ভারতে হেক্টরপ্রতি সার বাবদ ব্যয় হয় ৮৯ দশমিক ৫ ডলার। এর বিপরীতে বাংলাদেশে সমপরিমাণ জমিতে ব্যয় হয় ১২৪ দশমিক ৬ ডলার। সবমিলিয়ে সার, সেচসহ ভারতে কৃষকের হেক্টরপ্রতি ব্যয় ১৬০ দশমিক ৩ ডলার। অথচ বাংলাদেশে এ ব্যয় দাঁড়ায় ৪৩৪ দশমিক ৬ ডলারে। অর্থাত্ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষককে ২৭১ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হয়, যার ফলে সক্ষমতা কমছে তাদের।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. মনজুরুল হান্নান বলেন, সার্বিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় ক্ষুদ্র কৃষকের অবদান আমাদের নজরে এসেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বেশকিছু ক্ষেত্রে এখনই মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। বিশেষত উন্নত বীজ, যান্ত্রিকীকরণ ও খামার ব্যবস্থাপনায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ক্ষুদ্র কৃষকের সম্পৃক্ততা বাড়াতে কাজ চলছে। এছাড়া এসব কৃষককে প্রশিক্ষিত করা, তাদের বাজার সংযোগ বাড়ানোর পাশাপাশি সংগঠিতও করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনে বহুমুখিতা আনতেও সমর্থ হচ্ছেন তারা।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম