কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বুড়িগঙ্গা নদীর বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্য ছয় নদীতে। বর্ষাকালে এই দূষিত পানি বিভিন্ন নদী হয়ে গিয়ে পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। সদরঘাটের দূষণ এখন আর বুড়িগঙ্গাতে সীমাবদ্ধ নেই। আবর্জনার সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চাঁদপুর অঞ্চলের পদ্মা এবং মেঘনার মোহনাতেও। সদরঘাট থেকে নদীপথে মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, চাঁদপুর, বরিশাল ঘুরে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বৃহৎ নদী পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁ, গোমতী, ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষ্যার বিভিন্ন প্রান্তে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভয়াবহ এই দূষণ রোধ করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে এসব নদীর পানিও বিষাক্ত হতে হতে একটা সময় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যাবে। খোদ সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বলছে, নদীপথে সদরঘাট থেকে বরিশাল অঞ্চলে প্রতিদিন ৭ শতাধিক নিবন্ধিত যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করছে। এসব যানে প্রতিদিন প্রায় তিন লাখ মানুষ যাতায়াত করে। এদের ত্যাগ করা কমপক্ষে তিন হাজার ঘনমিটার বর্জ্য প্রতিদিন বুড়িগঙ্গাসহ এসব নদীতে সরাসরি ফেলা হচ্ছে।
দেশে নিবন্ধিত আরও ২০ হাজার ৮০০ মালবাহী নৌযানেও একই অবস্থা। ময়লা সংরক্ষণ বা ডিসপোজ করার ব্যবস্থা না থাকায় সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা ফেলা হচ্ছে নদীতে। এতে নদীর পানি হয়ে উঠছে ব্যবহারের অনুপযোগী। আর বুড়িগঙ্গার পানি ইতিমধ্যে এতটাই বিষাক্ত হয়েছে যে— মাছ, পোকা-মাকড়সহ কোনো প্রাণীই এ পানিতে বেঁচে থাকতে পারছে না। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে-মুখে রুমাল চেপে সদরঘাট ছাড়তে হচ্ছে যাত্রীদের।
শুধু মানব বর্জ্যই নয়, শিল্পকারখানা বর্জ্য, নগরবাসীর বর্জ্য, দোকানপাটের ময়লা-আবর্জনা এবং নৌযানের সব ধরনের ময়লা-আবর্জনা নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গাসহ সংশ্লিষ্ট নদীগুলোতে। সদরঘাট থেকে চলাচলকারী সুন্দরবন, সুরমা, কীর্তনখোলা, গ্রিনলাইন ওয়াটারবাস, পারাবত, আঁচলসহ বড় বড় লঞ্চের ভিতরে ময়লা ফেলার বিন রয়েছে। লঞ্চের যাত্রীদের অনেকেই এসব বিনে ময়লা ফেলছেনও।
কিন্তু দিন শেষে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ এসব বিনে জমানো পুরো ময়লাই সদরঘাট পৌঁছে বুড়িগঙ্গায় কিংবা বরিশাল, শরীয়তপুর, চাঁদপুর বা অন্য কোনো ঘাটে পৌঁছে সে অঞ্চলে নদীতে ফেলে দিচ্ছে। কেননা সে ময়লা অন্যত্র নেওয়ার কোনো ব্যবস্থাই নেই। আর মানব বর্জ্য সাময়িকভাবে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই এসব নৌযানে। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর দিয়ে অনেক ভিআইপি লঞ্চ চলে। সেগুলোতেও নেই ওই ব্যবস্থা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লঞ্চ বা অন্য নৌযান বানানোর আগে যে নকশা করা হয় সেই নকশাতেও এ ধরনের কোনো নির্দেশনা থাকে না। ফলে মানব বর্জ্য সংরক্ষণ এবং অন্য ময়লা ধরে রেখে তা ডিসপোজ করার কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি নৌযানে কিংবা ঘাটে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান কমডোর এস মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বুড়িগঙ্গার দূষণ ঠেকাতে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। লঞ্চ বা যাত্রীবাহী নৌযানের বর্জ্য ডিসপজালের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ জন্য সদরঘাট সংলগ্ন এলাকায় সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে একটি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে।
এ ছাড়া পরবর্তীতে যেসব লঞ্চ তৈরি করা হবে সেগুলোতে যেন মানব বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয় সে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। জানা গেছে, এসব নদীতে চলাচলকারী ৭ শতাধিক যাত্রবাহী নৌযানের কোনটিতেই মানব বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এমন কি বিলাসবহুল গ্রিনলাইনওয়াটার বাসেও সে ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশের নদীপথে চলাচলকারী কোনো নৌযানই তৈরির সময় এমন ব্যবস্থা রাখা হয় না, যাতে মানব বর্জ্য সংরক্ষণ করা যায়। কিংবা অন্য ময়লা-আবর্জনা ফেলারও কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশে যাত্রীবাহী কি মালবাহী সব নৌযানে সে ব্যবস্থা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পানি বিশেষজ্ঞ নঈম গওহার এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নদী দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। মানুষের একটা ধারণাই সৃষ্টি হয়েছে যে, নদীতেই ময়লা ফেলতে হবে। অথচ আগে কিন্তু এমন ধারণা ছিল না। আগে নদীকে পবিত্র ভাবা হতো। নদী বাঁচাতে না পারলে আমরাও বাঁচব না। জাহাজ মালিকরা শুধু তাদের স্বার্থের কথা ভাবেন কিন্তু নদীর কথা ভাবেন না। এই নদীই যদি না থাকে তাহলে তারা জাহাজ কোথায় চালাবেন এটা ভাবা উচিত। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) মনে করে বুড়িগঙ্গার পানি এতটাই দূষিত যে সেখানে কোনো মাছ বা কোনো পোকামাকড় বেঁচে থাকতে পারে না।
বুড়িগঙ্গার এই মরণদশার বড় কারণ মানব বর্জ্য আর হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকারখানা। শুধু হাজারীবাগের ২৫০ ট্যানারি কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২২ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য ও ১০ টন কঠিন বর্জ্যের প্রায় পুরোটাই ফেলা হয় বুড়িগঙ্গার পানিতে। পবার সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুস সোবহান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিদিন যেভাবে বুড়িগঙ্গাকে দূষিত করা হচ্ছে যার প্রভাবে অন্য ছয়টি নদীও দূষণের শিকার হচ্ছে। তাতে আগামী এক দশক পর হয়তো বুড়িগঙ্গার এই দূষণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়বে পদ্মা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা আড়িয়াল খাঁ, গোমতী এবং ধলেশ্বরীতে।
বিশেষ করে নৌযানগুলো কোনো ধরনের নিয়মকানুন না মানা এবং বাংলাদেশে চলাচলকারী কোনো নৌযানেই মানব বর্জ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এই দূষণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অন্য নদীতে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় বলছে, রাজধানী ঢাকার ভিতরে-বাইরে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মোট ১৮টি ছোট-বড় নদী। দখল আর দূষণে এর সবই আজ বিপন্ন। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রতিপক্ষ মানুষের বিরুদ্ধে লড়ছে বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা। আর জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার দূষিত পচা পানি ছড়িয়ে পড়ছে পদ্মা, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা, আড়িয়াল খাঁ, গোমতী এবং ধলেশ্বরীতে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মো. আতাহারুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নদীর পানিতে বর্জ্য বা যে কোনো ধরনের ময়লা ফেলা অন্যায়। আমাদের দেশে অবশ্য সে ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি, যার মাধ্যমে নৌযানগুলো নদীতে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে পারে। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে, এর পরিবেশ রক্ষায় এবং যাত্রীবাহী নৌযানের বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশে যেভাবে লঞ্চ, জাহাজ বা যে কোনো ধরনের নৌযানের নকশা করা হয় এবং তৈরি করা হয় তাতে কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড বিচার করা হয় না। ফলে এসব নৌযানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো ব্যবস্থা থাকে না।
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন / কৃপ্র/এম ইসলাম