কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ নাটোর জেলার চলনবিল অঞ্চল দখল-দূষণ আর ভরাটের কবলে পড়ে গ্রাস হচ্ছে নদী-নালা, খাল-বিল জলাশয়। ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে চলনবিলের আয়তন। কয়েক দশক ধরে শুষ্ক মওসুম ছাড়াও বর্ষা মওসুমেও পানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে কৃষি উত্পাদন। পেশা বদলেছে মত্স্যজীবী পরিবার। নদীপাড়ের এক কোটি মানুষ পড়েছে বিপর্যয়ের মুখে। ইন্সটিটিউট অব ওয়ার্টার মডেলিং (আইডব্লিউএম) এর ইরিগেষণ ম্যানেজমেন্ট ডিভিশনের সিনিয়র স্পেশালিস্ট ওই প্রকল্পের টিম লিডার মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, চারঘাট থেকে বাঘাবাড়ি পর্যন্ত বড়াল নদীর ১২০ কিলোমিটারের বেশিরভাগ দখল হয়ে গেছে। তা ছাড়া বাঘাবাড়ি থেকে বড়াইগ্রাম পর্যন্ত নদী অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। ওই নদীসহ চলনবিলের সকল নদী দখলমুক্ত ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
এসব বিষয়ের ওপর একাধিকবার বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসে বাড়ইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস, নাটোরের জেলা প্রশাসক, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী পরিচালক এবং প্রকৌশলীদের নিয়ে আলোচনা সভা করা হয়েছে। এই সমীক্ষার মাধ্যমে নদীর অতীত বর্তমান ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। নির্ধারিত ১৮ মাস সময়ের মধ্যেই সকল প্রক্রিয়া শেষ করা হবে।
এ ছাড়া প্রমত্তা পদ্মার শাখা নদী বড়াল রক্ষা, দখলমুক্তকরণ, বাঁধ অপসারণ, পুনঃখনন ও ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন ও চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটি। চলনবিলের নদী ও খালের মধ্যে আত্রাই, নন্দকুঁজা, গুমানী, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসি চেঁচিয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা ইত্যাদি। ১৮টি খালের মধ্যে নবীরহাজির জোলা, হকসাহেবের খাল, নিমাইচড়াখাল, বেশানীরখাল, গুমানীখাল, উলিপুরখাল, সাঙ্গুয়াখাল, দোবিলাখাল, কিশোরখালির খাল, বেহুলারখাড়ি, বাকইখাড়া, গোহালখাড়া, গাড়াবাড়ি খাল, কুমারভাঙ্গাখাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. মো. রেদওয়ানুর রহমানের প্রবন্ধ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ৩০ বছর আগেও চলনবিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এসব নদ-নদীতে বছর জুড়েই ৬-১২ ফুট পানি থাকত। ফলে বছর জুড়েই নৌচলাচল করতো। কিন্তু বছরের পর বছর পলি জমে এসব নদী ভরাট হয়ে গেছে।
পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আব্দুল মতিন, বড়াল রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও মিজানুর রহমান জানান, দেশের বৃহত্তম পদ্মা-যমুনা নদী এবং জলাভূমি বিশাল চলনবিলের মধ্যে প্রধান সংযোগ নদী হচ্ছে বড়াল। এই নদী চারটি জেলা ও আটটি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে উত্পত্তি হয়ে চলনবিলের মধ্যে দিয়ে মুশাখা, নন্দকুজা, চিকনাইসহ বেশ কয়েকটি নদীর জন্ম দিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির হুড়াসাগর হয়ে যমুনায় মিলিত হয়েছে। এক সময় এই নদী ছিল প্রবাহমান। কিন্তু ৮০’র দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ড অপরিকল্পিতভাবে নদীর উত্সমুখ ও ৪৬ কিলোমিটার ভাটি এলাকার আটঘরিয়ায় স্লুইসগেট নির্মাণ, পাবনার চাটমোহরে তিনটি ক্রস বাঁধ ও স্লুইসগেট নির্মাণের কারণে প্রমত্তা বড়াল বর্তমানে পুকুরে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া কয়েকটি শিল্প কারখানার তরল বর্জ্যে পানি দূষণসহ ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বড়াইগ্রাম বড়াল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব ডিএম আলমগীর জানান, বড়াল নদী চালু ও তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বড়াল রক্ষা আন্দোলন, চলনবিল রক্ষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও সর্বস্তরের মানুষ গত ২০০৮ সাল থেকে আন্দোলনে নামে। নাটোর, পাবনা ও রাজশাহীর সংসদ সদস্যরাও ওই আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে জনদাবির মুখে পানি উন্নয়ন বোর্ড টাস্কফোর্স গঠন করে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হককে ওই টাস্কফোর্সের সভাপতি করা হয়। নদী বিষয়ক টাস্কফোর্স এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভায় বড়াল নদীর সব বাধা অপসারণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে নদী উদ্ধারে কিছুই করা হয়নি। বড়াল নদীর ওপর নির্মিত সকল স্লুইসগেট-বাঁধ অপসারণ করে সেখানে প্রস্থ সেতু নির্মাণ করাসহ নদীর সীমানা চিহ্নিত ও দখলদার উচ্ছেদ করে অচল নদী সচল করতেই বিভিন্ন আন্দোলন।
বড়াল রক্ষা আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান জানান, চলনবিলের প্রধান নদী আত্রাই, নন্দকুঁজা ও গুমানীসহ ১৬টি নদ- নদীতে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দখল, দূষণ আর ভরাটের কারণে নদীগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ায় পানির অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে নদীর ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো বেকার হয়ে পড়েছে। স্থবিরতা নেমেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এসব নদীর পাদদেশে এখন চাষাবাদ করা হচ্ছে। নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল কুদ্দুস বলেন, চলনবিলসহ বড়াল নদীকে রক্ষা করতে পারলে উত্তরের আট উপজেলার এক কোটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত থাকবে।
সুত্রঃ ইত্তেফাক / কৃপ্র/এম ইসলাম