কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ধান চাষ থেকে কৃষক আয় করছেন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। একথা বলছে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) এক প্রতিবেদন। গোটা বাংলাদেশেই কৃষকরা এখন ধান উৎপাদন করছেন আগের চেয়ে অনেক বেশি। গত কয়েক দশকে দেশে ধানের ফলন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন গুণ। পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানের নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে এ অসাধ্য সাধন করেছে বাংলাদেশ। কৃষি ও প্রযুক্তির এ মিথস্ক্রিয়ায় দেশে জনসংখ্যা বাড়লেও ঘটেনি খাদ্য সংকট। শুধু তা-ই নয়, ধীরে ধীরে চাল আমদানিকারক থেকে রফতানিকারক হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। দেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি খাতে অনন্য এ অর্জন এখন কৃষি বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক মহলের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইএইএ এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সহযোগিতায় বিনাধান-৭সহ ধানের ১৩টি জাত উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। প্লান্ট মিউটেশন ব্রিডিং নামে বিকিরণনির্ভর এক ধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব ধানবীজ উদ্ভাবন করেছে তারা। দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের কাছে নতুন এসব ধানের জাত ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ধানের এসব জাত আবাদের মধ্য দিয়ে একদিকে কৃষকের আয় বাড়ছে, অন্যদিকে কৃষি শ্রমিকরাও বছরব্যাপী কাজের সুযোগ পাচ্ছেন।
পরমাণু প্রযুক্তির মাধ্যমে ধানের বিভিন্ন জাত উদ্ভাবনে কাজ করেছেন বিনার মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন অকাল বন্যা ও খরা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার কারণেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ফসল আবাদ। এ কারণে ফসলের জলবায়ুসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য নিউক্লিয়ার ও মিউটেশন (বংশগতিতে পরিবর্তন সাধন) প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
বিনা উদ্ভাবিত জাতের উপযোগিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, নতুন এসব জাতের ফসল দ্রুত ঘরে তোলা যায়। হেক্টরপ্রতি ফলনও বেশি। বিশেষ করে আমনের জনপ্রিয় দুটি জাত বিনাধান-৭ ও বিনাধান-১৬ ঘরে তোলার পর একই জমিতে সহজেই আলু, সরিষা, ডালজাতীয় বা রবিশস্য ফলাতে পারছেন কৃষক। বিনাধান-৭-এর মতো দেশে প্লান্ট মিউটেশন ব্রিডিং পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলোর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এগুলো বেড়ে উঠতে সময় নেয় খুব কম। অন্যদিকে এগুলোর ফলনও বেশি। দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা স্থানীয় সনাতন জাতের ধান চাষ করে সেখান থেকে চাল পান হেক্টরপ্রতি দুই টন। এসব ধান রোপণের পর ফসল কাটার উপযোগী হতে সময় লাগে প্রায় ১৫০ দিন। অন্যদিকে বিনাধান-৭ আবাদে হেক্টরপ্রতি চাল পাওয়া যায় সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার টন। এছাড়া রোপণের ১১৫ দিনের মধ্যেই এ ধান কাটার উপযোগী হয়ে ওঠে।
এ ব্যাপারে ময়মনসিংহের কৃষক সুরুজ আলী বলেন, ‘বিনাধান-৭-এর আবাদ শুরু করার আগে আমি বছরে দুটি ফসল ফলাতে পারতাম। বছরের কয়েক মাস কোনো কাজ না করেই বসে থাকতে হতো। কিন্তু বিনাধান-৭ আবাদ শুরু করার পর থেকে একই জমিতে আবাদ করতে পারছি বছরে তিনটি ফসল। এতে আমার আয়ও হচ্ছে প্রায় সারা বছর। উপার্জিত বাড়তি টাকা দিয়ে আমার ঘরটুকু সম্প্রসারণ করে নিয়েছি এরই মধ্যে। আশা করি, ভবিষ্যতে আমার সন্তানদের বিদেশে পাঠানোর মতো যথেষ্ট টাকা এখান থেকেই আয় করে নিতে পারব।’
বিনার হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সালে প্রথম আবাদ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত বিনাধান-৭ আবাদ করে উত্তরাঞ্চলের ২০ শতাংশেরও বেশি মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটেছে। দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভাত তথা চালের চাহিদা এখন আগের চেয়েও বেশি করে মেটানো সম্ভব করেছে বিনাধান-৭-এর মতো ধানের নতুন এসব জাত। স্থানীয় সনাতন পদ্ধতিতে আবাদকৃতের তুলনায় নতুন এসব জাতের চালের ফলনও বেশি। অর্থাত্ এসব ধান চাষ করে এখন খাওয়া ও বিক্রির জন্য চাল পাওয়া যাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
দেশে বর্তমানে প্রতি বছর চাল উৎপাদন ও ভোগ হচ্ছে গড়ে ৩ কোটি ৬০ লাখ টনেরও বেশি। বৈশ্বিক চাল উৎপাদন ও ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে এখন রফতানিকারকও হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।দেশের কৃষকদের জন্য এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সেচের পানির অভাব, খরা, জমির লবণাক্ততা ও উর্বরা শক্তি হ্রাস। এসব সমস্যার কারণে জমিতে উৎপাদিত ফসলের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে উর্বরা শক্তি হারিয়ে ধীরে ধীরে জমি হয়ে উঠছে চাষের অনুপযোগী। নতুন উদ্ভাবিত জাতের ফসলগুলো আবাদের মাধ্যমে এখন কৃষকরা এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে পারছেন।
পরমাণু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলছে বিনা। এছাড়া শিম, ডাল ও তেলজাতীয় আটটি ফসলের জন্য জীবাণু সার উদ্ভাবন করেছেন সংস্থাটির গবেষকরা। মাটির গুণাগুণ রক্ষা ছাড়াও ডাল ও তেলজাতীয় ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে এটি। শুধু উত্তরাঞ্চল নয়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিগুলোয়ও এখন বিনা উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধানের আবাদ শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে বিনার মহাপরিচালক ড. মো. শমসের আলী বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় চার লাখ হেক্টর লবণাক্ত জমি বিনা উদ্ভাবিত ধানের নতুন জাতের আবাদের আওতায় চলে এসেছে। এছাড়া উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর করায় ভূমিকা রেখেছে বিনা উদ্ভাবিত ধানের দুটি জাত। তিনি জানান, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিনা যেসব ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে সেগুলো হলো— শস্য নিবিড়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন, গুরুত্বপূর্ণ জিন পৃথকীকরণ ও জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ফসল উদ্ভাবনসহ সহযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন, স্থানীয় জনপ্রিয় জাতের উন্নয়ন ছাড়াও প্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী জাত ও প্রযুক্তির উদ্ভাবন। ফসলের পুষ্টিসমৃদ্ধ জাত উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় জাত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছে বিনা।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম