কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ প্লাস্টিক পাইপ দিয়ে মাদুর তৈরি করে সচ্ছল হয়েছে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার আট গ্রামের মানুষ। বাড়ির গৃহবধূ থেকে বেকার তরুণ-তরুণী প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে মাদুর-পাটি তৈরি করে আজ স্বাবলম্বী। তাদের তৈরি বাহারি মাদুর কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন জেলার পাইকাররা। এই মাদুর নিয়ে বসছে হাটও। জানা গেছে, বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বনপাতি চাষ হয়। এই বনপাতি দিয়ে মাদুর, পাটি, বাসনপত্র তৈরি করেন বাসিন্দারা। তবে এ দিয়ে তৈরি মাদুর ও বাসনপত্র থেকে খুব বেশি আয় হতো না কারিগরদের। কারণ উত্পাদন ব্যয় বেশি ছিল।
লোকসানে পড়ে এই শিল্পের অনেক কারিগর অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। কিন্তু বিপ্লব ঘটে বছর তিনেক আগে আদমদীঘি উপজেলার নওগাঁর ত্রিমোহনী এবং আদমদীঘি ইউনিয়নের হালালিয়ায় হাটে প্লাস্টিকের পাইপ তৈরির মিল স্থাপনের পর। এই মিলে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় পুরনো ভাঙা প্লাস্টিক। পুরনো প্লাস্টিক গলিয়ে পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে নতুন গামলা, ঢাকনা, মগ, গ্লাসসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি হয় কারখানায়। এখানেই ছাট প্লাস্টিক গলিয়ে তৈরি করা হয় চিকন পাইপ। এই পাইপ দিয়ে তৈরি হয় মাদুর। মানসম্পন্ন ও সাশ্রয়ী হওয়ায় হাতে তৈরি বাহারি কারুকাজে ভরা মাদুরগুলোর চাহিদা বাড়ছে দিন দিন। তাই বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার সান্তাহার ইউনিয়নের সান্দিড়া, তারাপুর, কাজিপুর, ছাতনী, ঢেকড়া, প্রাণনাথপুর, শিমুলিয়া, মালশন গ্রামের বেকার তরুণ-তরুণীরা প্লাস্টিকের মাদুর তৈরি করে দোকানে বিক্রি করছেন। বসে নেই গৃহবধূরাও। তারা সংসারের কাজের ফাঁকে মাদুর বুনছেন।
স্থানীয় সান্তাহার ইউনিয়নে হেলালিয়া হাটে পাইকারদের কাছে মাদুর বিক্রি করেন কারিগররা। এসব মাদুর পাইকাররা সরবরাহ করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সপ্তাহের দুদিন রবি ও বৃহস্পতিবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত হাটে চলে মাদুর বিকিকিনি। সান্দিড়া গ্রামের একাধিক কারিগর জানান, আগে বনপাতি দিয়ে মাদুর তৈরি করে তা বিক্রি করা হতো। বনপাতির ভালো ফলন না হলে মাদুর তৈরিতে সমস্যা হয়। কিন্তু এখন প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বনপাতি চাষের খরচটাও বেঁচে যাচ্ছে।
একই এলাকার আব্দুল জলিল জানান, এই পেশায় অর্থ লগ্নি কম বলে আয় বেশি। উত্তরাঞ্চলের উপজেলা, জেলার গ্রাম পর্যায়ের প্রতিটি ঘরে মাদুরের চাহিদা ও ব্যবহার রয়েছে। এ কারণে মাদুর প্রতিদিনই বিক্রি হয়ে থাকে। এটি বিক্রি করে বেশ সচ্ছল হয়েছেন তিনি। বগুড়া শহরের ২ নং রেলঘুমটি এলাকায় ফেরি করে প্লাস্টিক মাদুর বিক্রি করেন আল আমিন। তিনি জানান, প্রতিদিন গড়ে ৯০-৯৫টি প্লাস্টিকের মাদুর বিক্রি হয়। এর রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। দেখতে সুন্দর হওয়ায় অনেকে ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে এটি ব্যবহার করছেন। আবার কেউ মাদুর হিসেবেই ব্যবহার করছেন। দাম নির্ভর করে আকারের ওপর। সর্বনিম্ন ৮০ থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকায় বিক্রি হয় মাদুর। দৈনিক ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা আয় করেন তিনি।
মাদুর তৈরির প্রধান উপকরণ প্লাস্টিকের পাইপ মিল মালিকরা খুচরায় প্রতি গজ ১২০ টাকায় বিক্রি করেন। এসব পাইপ তৈরিতে খরচ পড়ে ৫০-৭০ টাকা। তবে ব্যাপক চাহিদা থাকায় আদমদীঘি উপজেলায় দুটি কারখানা মাদুর তৈরির প্রধান উপকরণগুলো সময়মতো সরবরাহ করতে পারছে না। দুই বছর ধরে প্লাস্টিকের মাদুর তৈরি করে খুচরা ও পাইকারি দরে বিক্রি করেন কাজীপুর গ্রামের বিপুল সরদার। জায়নামাজের মাপে দুই বাই চার ফুট মাদুরই বিক্রি হয় বেশি। আগে বনপাতি দিয়ে তৈরি মাদুরে মুনাফা কম হতো। এখন প্লাস্টিকের মাদুরে আয় ভালো হচ্ছে। খুলনার কয়েকটি হাটে এ মাদুর বিক্রি হয় বলে জানান রংপুরের কাউনিয়া এলাকার পাইকারি ক্রেতা রফিকুল ইসলাম।
সান্তাহার ইউনিয়নের ছাতনী গ্রামের প্লাস্টিক মিল মালিক গফুর সর্দার দুই বছর আগে প্লাস্টিক পাইপ তৈরির কারখানা চালু করেন। প্লাস্টিকের পাইপের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। কারিগরদের দেয়া চাহিদাপত্র জমা পড়ে আছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী পাইপ সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এই শিল্পে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রান্তিক জনপদে এই ব্যবসার আরো প্রসার ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
বগুড়ার সান্তাহার ইউপি চেয়ারম্যান এরশাদুল হক টুলু বলেন, প্লাস্টিকের পাইপে তৈরি মাদুর শিল্পে বেকাররা আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছে। আগে অনেক পরিবার জীবিকা নির্বাহ করত দিনমজুরি করে। এখন তারা প্লাস্টিক দিয়ে মাদুর, পাটি তৈরি করে স্থানীয় হাটে তা বিক্রির মাধ্যমে অন্নসংস্থান করছেন।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম