কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ব্রাহ্মণবাড়িয়া আশুগঞ্জ নৌবন্দরের পাশের ছোট্ট গ্রাম চরসোনারামপুর। এই গ্রামে হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে অল্প সময়ের জন্য এসে বসতি গড়েন এক শ্রেণির মানুষ, যারা যাযাবর বলে পরিচিত। ভাসমান এই মানুষেরাই চমক সৃষ্টি করেছেন হাঁস পালনে। দেখা গেছে, হাওরাঞ্চল এলাকায় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কর্মের অভাব দেখা দেয়। ওই সময়ই গ্রামের কৃষকরা বেরিয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। তাদেরই একটি অংশ ছোট ছোট হাঁসের বাচ্চা নিয়ে চলে আসেন মেঘনা নদীর উপর ভেসে ওঠা চরসোনারামপুর গ্রামে। এখানে তারা গড়েন অস্থায়ী বসতি।
নদীর চরে তাঁবু পেতে জাল (নেট) দিয়ে বসত গড়েন। সেই সঙ্গে নদীর একটি অংশে দেন বেড়া। আর এই বেড়ার ভিতর পালন করেন হাজার হাজার হাঁসের বাচ্চা। বাচ্চাগুলো একটু বড় হলেই ডিম দেওয়া শুরু করে। পুরো ডিম দেওয়ার সময়টুকু এই চরেই থেকে যান এসব মানুষের দল। তাদের হাঁস সারা দিন পানিতে খেলা করে। সন্ধ্যা হলেই জাল দিয়ে বানানো ঘরে এসে আশ্রয় নেয়। ভোর রাতে হাঁসগুলো ডিম পাড়ে। ফজরের নামাজের সময় এসব ডিম সংগ্রহ করেন হাঁসের মালিকরা।
জানা গেছে, গ্রামের চারপাশে নদীর তীরে একের পর এক জাল দিয়ে বেড়া বানিয়ে হাঁস পালন করছেন এই যাযাবরেরা। তারা তাদের হাঁসগুলোর শরীরে রং দিয়ে আলাদা আলাদা চিহ্ন দিয়ে রাখেন, যাতে এক ঘেরের হাঁস অন্য ঘেরের সঙ্গে মিশে না যায়। ৮০০ হাঁসের মালিক আ. হামিদ বলেন, ‘সেই অষ্টগ্রাম থেকে এসেছি শুধু হাঁস পালন করতে। মেঘনা নদীর তীরে ৩-৪ মাস হাঁসগুলো পালন করে আবার চলে যাব নিজের এলাকায়। এভাবে প্রতি বছরই হাঁস নিয়ে এই চরে আসি। অনেকটা যাযাবরের মতো। ’ একই কথা বলেন, শহীদুল ইসলাম নামের আরেকজন। তিনি অষ্টগ্রাম থেকে নিয়ে আসেন এক হাজার হাঁস। এখন তার হাঁসগুলো ডিম দিচ্ছে। এ ছাড়া হিরন মিয়া পালন করছেন ২ হাজার ৫০০ হাঁস। আব্বাস উদ্দিনের রয়েছে এক হাজার ২০০ হাঁস। নদীর চরে এভাবে শতাধিক ঘের রয়েছে। ইসমাইল নামের একজন কয়েকটি ঘেরে ১৩ হাজার হাঁস পালন করছেন।
হাসিব উদ্দিন নামের একজন বলেন, ‘এখানকার ঘেরের মালিকরা জানুয়ারির শুরুর দিকে হাঁস নিয়ে এই চরে আসেন। ৩-৪ মাস পালন করে আবার চলে যান এলাকায়। নিয়ে আসা এসব হাঁস সাধারণত ৫ মাস বয়সের হয়। ’ হাঁস পালনকারী মিনহাজ বলেন, ‘হাঁসের ডিম আশুগঞ্জ বাজারে বিক্রি করা হয়। যা আয় হয় তা থেকে খাবার-দাবারের খরচ মিটিয়ে কিছু আয় থাকে, যা বাড়িতে নিয়ে যাই।
’ জানা গেছে, এসব হাঁসের খাবার হিসেবে ধান, গম, শামুক কিনে আনা হয় আশুগঞ্জ বাজার থেকে। শামুক কেনা হয় বস্তা হিসেবে। একেকটি বস্তা ১৩০ টাকা ধরে কিনতে হয়। ডিম পাড়া ১০০ হাঁসের সঙ্গে ১০টি পুরুষ হাঁস হিসেবে দলে রাখতে হয়। এসব ডিম বাচ্চা উৎপাদনে ব্যবহার হয়। তবে হাঁসগুলোকে তিনমাস অন্তর অন্তর ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়। সরেজমিন দেখা গেছে, বন্দরনগরী আশুগঞ্জ বাজার থেকে ঠিক দুই মিনিটের নদী পথ পাড়ি দিলেই চরসোনারামপুর গ্রাম। চর হলেও এখানে বসতি অন্তত ১০ হাজার সাধারণ মানুষের। গ্রামটি সবুজ গাছে আচ্ছাদিত। আর এই গ্রামের বাসিন্দাদের সিংহ ভাগই হিন্দু সম্প্রদায়ের। চরের গ্রামটিকে দুইভাবে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগ পূর্বপাড়া ও অন্যটি পশ্চিমপাড়া। গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা যতিশ বর্মণ জানান, চরের নদীর তীরে প্রতি বছর দূর-দূরান্ত থেকে যাযাবররা আসেন শুধু হাঁস পালন ও ডিম উৎপাদন করতে।
আশুগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী শীতল বর্মণ জানান, চরে ভাসমান হাঁসের ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আশুগঞ্জ বাজারে অন্যান্য ডিমের চেয়ে এখানের ডিমগুলো বাচ্চা উৎপাদনে শতভাগ এগিয়ে রয়েছে। চরসোনারামপুর গ্রামের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হেলাল খান বলেন, ‘হাওর এলাকা থেকে শুকনা মৌসুমে যাযাবরের মতো এখানে ছুটে আসেন হাঁস পালন করতে। আমরাও উৎসাহ জোগাই এদের। কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হয় না। ’ একই কথা জানান মহিলা ইউপি সদস্য কবিতা রানী দাস। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান জিয়াউল হক মৃধা বলেন, মেঘনা নদীতে ভেসে ওঠা গ্রাম চরসোনারামপুর। আসলেই গ্রামটি সোনার মতো। এখানে হাওর এলাকার দরিদ্র লোকজন হাঁস এনে পালন করে আবার চলে যায়।
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন/ কৃপ্র/এম ইসলাম