আনু মোহাম্মদ: কৃত্রিম প্রজনন একটি জৈবপ্রযুক্তি যার যথাযথ ব্যবহার বয়ে আনতে পারে অভূতপূর্ব সফলতা। আমাদের দেশে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে গত ৩৫ বছরে জাত উন্নয়ন চলছে। এই ৩৫ বছরে সময়ে দেশে গবাদি পশুর সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে। তার ধারাবাহিকতায় অনেক উন্নত জাতের গাভী পেয়েছি। কিন্তু আমারা কি বিশুদ্ধ জাত জাত কি পেয়েছি? সেই সব উন্নত জাতের গাভী থেকে তো আমাদের ৩৫-৪০ লিটার দুধ পাওয়ার কথা ছিল। আমরা কি তা পাচ্ছি? কিন্তু সেই তুলনায় কি গাভীর দুধ বেড়েছে ? না আমরা কিছুই পাইনি বরং আমাদের দেশে গাভী প্রতি গড় দুধ উৎপাদন কমেছে। যেখানে অন্যান্য দেশে বাড়ছে। কিন্তু কেন গাভী গড় দুধ উৎপাদন কমেছে সেটা কি কোন খামারি খুজে দেখেছেন? এছাড়া গাভী গুলো দিনে দিনে খর্বাকৃতি হচ্ছে। এটা কি কেহ লক্ষ্য করেছেন? না করেন নি।
একটি ভাল মানের দুধেল গাভী পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। আমরা সবাই ভাল মান ও জাতের গাভী খুজি কিন্তু ভাল মান ও জাতের গাভী কি করে তৈরি করতে হবে সেদিকে কারো কোন নজর নাই। প্রত্যেকেই চিন্তা করি আমার গাভীকে উচ্চ মাত্রায় ফরেন ব্লাডের সিমেন পুশ করার এবং বছর শেষ সেই গাভী থেকে একটি সাধা কালো ছোপ অথবা কাল সাদা ছোপ যুক্ত বাছুর পাওয়া। আর সেটা পেয়ে গেলেই আমাদের সব পাওয়া হয়ে গেলে। কিন্তু আমরা খোজ নিয়ে দেখিনা যে আমি যে সিমেন টা দিলাম সেটা কেমন? সেটা ইনব্রিডিং হলো কিনা? অনেকেই প্রশ্ন জেগেছে যে ইনব্রিডিং কি?
ইনব্রিডিং (Inbreeding) বা অন্তঃপ্রজনন। আমদের দেশের ৯০% ডেইরি খামারি জানেনা ইনব্রিডিং কি বা কিভাবে হয় এবং এর পরিণতি কি। না জানারই কথা কারন ইনব্রিডিং (Inbreeding) বা অন্তঃপ্রজনন নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়না। অনেকেই আজ হয়ত প্রথম শুনলেন বা জানলেন। আমাদের দেশের খামারিরা নিজের অজান্তেই ইনব্রিডিং সিমেন পুশ করছেন আর জানলেও কিছু করার থাকছে না কারন নিজের ভাল মানের ষাঁড় না থাকার কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে কৃত্রিম প্রজননের জন্য। ইনব্রিডিং (Inbreeding) বা অন্তঃপ্রজনন অর্থাৎ কাছাকাছি জিনের মধ্যে মিলন। রক্তের সম্পর্কের সাথে মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে সেটাই ইনব্রিডিং। ইনব্রিডিং হচ্ছে জেনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিকট সম্পর্কযুক্ত পিতামাতা হতে প্রজন্মের সৃষ্টি।
যেমন
ক) ভাই x বোন = ইনব্রিড
খ) মা x ছেলে = ইনব্রিড
গ) বাবা x মেয়ে = ইনব্রিড
এভাবে বংশ পরম্পরায় যদি হতে থাকে সেটা ইনব্রিডিং।
প্রানী সম্পদে ইনব্রিডিংঃ– প্রাণীর মধ্যে পুনঃপুনঃ প্রজনন হলে ইনব্রিডিং প্রানী তৈরি হয়। বিশ্বজুড়ে প্রজাতির সংখ্যা কমে আসায় অন্তঃপ্রজনন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমাদের প্রাণিসম্পদের সর্বক্ষেত্রেই ইনব্রিডিং সমস্যার প্রকট আকারে ধারন করেছে। আমাদের দেশের দেশী, হাঁস, মুরগি, ব্লাক বেঙ্গল ছাগল, ভেড়া, দেশী গরু কোন প্রানীতে নাই ইনব্রিডিং? ইনব্রিডিং এর ফলে দেশী মুরগির আকার ছোট হয়ে আসছে, ডিম উৎপাদন নাই বললে চলে, তেমনি হাঁসের ক্ষেত্রে, ছাগলের আকার তো দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে। এগুলো ইনব্রিডিং এর প্রতিক্রিয়া।
ডেইরি শিল্পে গুটিকয়েক উন্নত জাতের বিদেশী ষাঁড়কে পূনঃপূনঃ ব্যবহারের ফলে ইনব্রিডিং পশু সারা দেশে ছড়িয়ে পরছে। ইনব্রিডিং প্রক্রিয়ায় খামারীর ঘরে ঘরে পালিত হচ্ছে গাভী। আর এভাবে আমরা হারাতে বসছি অনেক কষ্টের বিনিময়ে তৈরি করা ভাল মানের জাতের প্রানী সম্পদ।
ইনব্রিডিংয়ের কুফলঃ– রক্তের সম্পর্কের সাথে মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে সেটাই ইনব্রিডিং। ইনব্রিডিং পদ্ধতিতে অনুন্নত জাতকে বিশুদ্ধ জাতে পরিনত হয় (রক্তের বিশুদ্ধতা)। তবে এটি এক বারের চেয়ে বেশি না। আমাদের মধ্যে রক্তের সম্পর্ক বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ ও নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে বিজ্ঞানসম্মত নয় (দ্য ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য জানিয়েছেন)। চাচাতো, মামাতো, খালাতো ও ফুফাতো ভাই-বোনদের মধ্যে বিয়ের পরিণামে যে সন্তান হয়, তার মধ্যে জন্মগত ও স্বাস্থ্য ত্রুটি দেখা দেয়ার ঝুঁকি বেশি।
নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের জিনগত অস্বাভাবিকতার হার এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি সাধারণ শিশুদের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। ভাই বোন প্রজননে প্রতি জেনারেশনেই ২৫% জেনেটিক গুনাগুন হ্রাস পায়। পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতাও কমে যেতে থাকে। ইনব্রিডিংয়ের ফলে স্পার্ম বা শুক্রাণুর মানের উপরে প্রভাব ফেলে। এদের শুক্রাণু ডিম্বাণুকে নিষিক্ত না করতে পারার অনুপাত ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। বংশগতির সাধারণ সূত্রানুসারে স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই যদি একই জীন লুকায়িত (Recessive) থাকে তাহলে শতকরা ২৫ ভাগের মতো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্ভাবনা থেকে যায় ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সন্তান জন্মানোর। এবং ৫০% সম্ভাবনা থাকে এ জীনের বাহক হওয়ার। ঠিক তেমনি প্রানী জগতের বিষয়টি একই রকম।
প্রাণীতে ইনব্রিডিং হলে কি হয়
ক) উন্নত জাতকে অনুন্নত জাতে রূপান্তরিত হয়।
খ) শাররীক বৃদ্ধির হার খুবই কম ও দূর্বল প্রকৃতির হয় এবং খর্বাকৃতি আকারের হয়।
গ) জন্মগত ত্রুটি, শাররীক বিকলাঙ্গতা চলাফেরা অসামঞ্জস্যতা, বাঁকা মুখমন্ডল বা চোখ ডাবানো হয়।
ঘ) শরীরে লোমের আধিক্য।
ঙ) জন্ম অন্ধত্ব।
চ) বিভিন্ন চর্মরোগ।
ছ) স্নায়ুকোষের ক্ষয়।
জ) মৃত বাচ্চা প্রসব।
ঝ) নবজাতকের উচ্চ মৃত্যুহার।
ঞ) নিম্নতর জন্ম ওজনে জন্ম নেয়া।
ট) দুধ ও মাশেংর উৎপাদন কম হওয়া।
ঠ) শুক্রাণুর উর্বরতা কম।
ড) দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
ঢ) ১ বারে গর্ভধারন করতে না পারা, বারবার প্রজনন করানো।
ণ) ষাড়ের প্রজনন ক্ষমতা না থাকা অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব।
ত) গাভীর গর্ভধারন ক্ষমতা না থাকা অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব।
দ) পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা।
ধ) প্রতি জেনারেশনেই ২৫% জেনেটিক গুনাগুন হ্রাস পায়।
অপরদিকে যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক নাই তাদের মিলন হল আউট ব্রিডিং (outbreeding) পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে চমৎকার, শক্তিশালি, উর্বর, সুস্থ, বাচ্চা জন্মায়। আউটব্রিড প্রাণী হতে সবচেয়ে বেশি (মাংশ/দুধ) উৎপাদন পাওয়া যায়। তাই আউট ব্রিডিংয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
ইনব্রিডিং থেকে মুক্ত থাকার উপায়
ক) রক্তের সম্পর্কের পশুদের মধ্য প্রজনন না করানো।
খ) ষাঁড় দিয়ে প্রজনন।
গ) একই ষাঁড় পুনঃপুনঃ প্রজনন কাজে ব্যবহার না করা।
ঘ) কৃত্রিম প্রজননে একই ষাঁড়ের সিমেন পুনঃপুনঃ প্রজনন কাজে ব্যবহার না করা।
ঙ) একই প্রতিষ্ঠানের সিমেন পুনঃপুনঃ প্রজনন কাজে ব্যবহার না করা।
চ) সম্ভব হলে প্রতিবার আলাদা আলাদা জাতের বীজ বা ষাঁড় দিয়ে গাভীকে প্রজনন করানো যেতে পারে। যেমন ফ্রিজিয়ান, জার্সি, ব্রাহমা, শাহীওয়াল ইত্যাদি তাতে ইনব্রিডিং হবার ভয় থাকবে না।
ছ) গাভীর কৃক্রিম প্রজননের সব রেকর্ড সংগ্রহ করে রাখবেন। পরবর্তি প্রজন্মকে প্রজনন করানোর সময় পূর্বের দেয়া সিমেনের রেকর্ড চেক করে দিবেন। যদি একই ষাঁড়ের সিমেন হয় তাহলে সেটা দেয়া যাবে না। দিয়েই ইনব্রিডিং হবে।
আমাদের দেশে যেহেতু ছোট ছোট ডেইরি খামারি সংখ্যায় বেশী তাই তারা এই বিষয় গুলো তাদের কাছে প্রাধান্য পায়না। তাদের কিছুই করার থাকে না কারন তাদের নিজের কোন উন্নত জাতের বা মানের বুল নাই। ডেইরিতে ক্রসব্রিডকে আউট-ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে যদি ইনব্রিডিং মুক্ত করা যায় তাহলে খামারিগন এখন যেখানে ১০ টি গাভী পালন করতে হচ্ছে তখন সেখানে তার ২ টি গাভী পালন করলেই হবে। কারন ইনব্রিডিং থেকে মুক্ত হয়ে আউটব্রিডিং যুক্ত গাভী পাবার ফলে তাদের গাভী গুলো থেকে প্রচুর দুধ উৎপাদন করতে সক্ষম হবেন।
ক্রসব্রিড গাভী থেকে যদি আউটব্রিডিং গাভী যদি তৈরি করা যায় তাহলে আমাদের দেশে ভাল মানের বা ভাল জাতের ২৫-৩০ লিটার দুধ দেয়া গাভীর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাবে এবং ভাল মানের গাভীর সঙ্কট দূর হবে। উপ কৃত হবে এদেশের ডেইরি খামারিরা। তাই আমাদের সবার এখনি স চেতন হতে হবে এবং এগিয়ে আস্তে হবে ইনব্রিডিং মুক্ত প্রানী জগত তৈরি করতে। আর সেটা যদি আমরা করতে পারি তাহলে এদেশে শ্বেত বিপ্লব সম্ভব। আর যদি তা না করতে পা্রি তাহলে দিনে দিনে আমাদের দেশের প্রানী সম্পদ গুলো ইনব্রিডিং হতে হতে অনুন্নত জাতে পরিণত হতে হতে এক সময় হারিয়ে যাবে এই উন্নত জাতের গাভী গুলো।
আমি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ নই তারপরও কিছু লেখার চেষ্টা মাত্র। ভুল ভ্রান্তি গুলো ক্ষমা করে শুধরে দিবেন। অভিজ্ঞজনদের তথ্য, মতামত, পরামর্শ দিয়ে সাহায্য পার্থনা করছি। সকলকে ধন্যবাদ।
লেখকঃ কৃষি গবেষক ও কৃষি উদ্যোক্তা
কৃপ্র/এম ইসলাম