কৃষিবিদ মো. আল-মামুন: কেনাফ পাটের মতো পরিবেশবান্ধব অাঁশজাতীয় ফসল। উষ্ণম-লীয় ও অবউষ্ণ দেশগুলোয় অাঁশ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ কেনাফ উৎপাদনকারী প্রধান প্রধান জেলা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর দেশে ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে কেনাফ ও মেস্তা চাষ হয়েছে এবং ৩ লাখ ৩৭ হাজার বেল অাঁশ উৎপাদিত হয়েছে। যদিও আমাদের দেশের অনেক এলাকায়ই কেনাফ আঞ্চলিক ভাষায় মেস্তা হিসেবে পরিচিত। চলতি ২০১৭-১৮ পাট উৎপাদন মৌসুমে ৮ লাখ ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে পাট ও কেনাফ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে ভারত থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রত্যায়িত মানের ১০৫৩ মেট্রিক টন কেনাফ বীজ আমদানি করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত কেনাফ বীজ সঠিক সময়ে আবাদ করা সম্ভব হলে এ বছর কর্তিত জমির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে।
মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতো কেনাফের গুরুত্বও অপরিসীম। কেনাফ ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরি স্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির ওপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে ১০০ দিন সময়ের মধ্যে প্রতি হেক্টর কেনাফ ফসল বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুম-লকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেনসমৃদ্ধ রাখে। কেনাফ অাঁশ থেকে কাগজের পাল্প বা ম- তৈরি করে নিউজপ্রিন্ট মিলের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, কেনাফ খড়ি হার্ডবোর্ড বা পার্টেক্স মিলের কাঁচামাল ও চারকোল তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। তাছাড়া কেনাফ খড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার এবং বীজ থেকে ঔষধি গুণসম্পন্ন তেল পাওয়া যায়। পৃথিবীর বহুদেশে কাগজের ম- ও উন্নতমানের কাগজ ছাড়াও বহু মূলবান দ্রব্যসামগ্রী কেনাফ থেকে উৎপাদিত হয়। কেনাফ অাঁশ পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পজাত দ্রব্য হিসেবে কাগজের ম-, বোর্ড, জিও টেক্সটাইল চট, কম্বল, প্লেন পার্টস, মোটর কার পার্টস, কম্পিউটার পার্টস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য শিকা, মাদুর, জায়নামাজ, টুপি, স্যান্ডেল এবং কাপড়-চোপড়জাতীয় সোফার কভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, কুশন কভার, সাটিং-সুটিং, পাঞ্জাবি, সোয়েটার ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ইনটেরিয়র ইনস্যুলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২ ও এইচসি-৯৫ কেনাফ জাত নিয়ে গবেষণা শেষে রিপোর্টে বলা হয়েছে, যেখানে লবণাক্ততার জন্য পাটচাষ সম্ভব নয়, সেখানে অনায়াসেই কেনাফ চাষ সম্ভব এবং বীজের অঙ্কুরোদগম ও গাছ বৃদ্ধির সময় কেনাফ ৮ থেকে ১৪ ডিএস/মি. পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। গবেষণাগারে সফলভাবে কেনাফ খড়ি এবং অাঁশ থেকে কাগজের ম- ও কাগজ এবং কেনাফ বীজ থেকে ৭ থেকে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত তেল পাওয়া যায় বলে দাবি করেছেন গবেষক দল। অনুরূপভাবে বিজেআরআইয়ের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পরীক্ষণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে কেনাফ চাষের সফলতা পেয়েছেন। লবণাক্ততা, খরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাত এই তিনটি পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই কেনাফ বেড়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উঁচু, মধ্যম, নিচু, হাওর এলাকা, পাহাড়ি এলাকার ঢালু জমি এবং উপকূলীয় ও চরাঞ্চল ফসলে উৎপাদনের উপযোগী নয় বা আউশ ফসলের জন্য লাভজনক নয় এমন অনুর্বর জমিতেও অল্প পরিচর্যায় কেনাফ চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যায়। দেশে যেসব এলাকায় সেচের ব্যবস্থা নেই সেখানে ধানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি খরা ও জলাবদ্ধতা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ চাষ কৃষকের প্রথম পছন্দ। তা ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় ৩ থেকে ৪ লাখ হেক্টর জমি আছে যেখানে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু পাট ও কেনাফ ছাড়া অন্য কোনো ফসল চাষ সম্ভব নয়। পাটের চেয়ে কেনাফের নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে এবং রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।
দেশের কৃষি পরিবেশ ও কৃষকদের চাহিদা বিবেচনায় গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ দ্রুত বর্ধনশীল, জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু, চরাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে চাষাবাদ উপযোগী বিজেআরআই কেনাফ-৪ (লাল কেনাফ) জাতটি সারাদেশে চাষাবাদের নিমিত্তে ছাড় করণের অনুমোদন দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। জাতটি পাটের মতোই অাঁশ উৎপাদনকারী এবং মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত একটি উন্নত জাত। জাতটির কা- লাল রঙের এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, যা এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত জাতসমূহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অধিক ফলনশীল ও বায়োমাস সম্পন্ন এ জাতটি কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারিত হলে অনাবাদী ও অনুর্বর জমিও চাষাবাদের আওতায় আসবে এবং পাটচাষিরা অধিক লাভবান হবেন। ভারতীয় জাতের কেনাফ ফসলে পাতার মোজাইক রোগ তুলনামূলকভাবে বেশি সংক্রমিত হওয়া এবং গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হওয়ায় বর্তমানে বিজেআরআই উদ্ভাবিত এইচসি-২, এইচসি-৯৫ ও বিজেআরআই কেনাফ-৩ (বট কেনাফ) সারাদেশে উন্নত জাত হিসেবে কৃষকের কাছে অধিক সমাদৃত।
কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও রংপুরের অঞ্চলের অগ্রগামী কৃষকরা কেনাফ ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বপন শুরু করেন যাতে পরে এ ফসল কেটে অনায়াসেই আমন ধান রোপণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু গাছে আগাম ফুল চলে এলেও কেনাফ ফসলের ক্ষেত্রে ফুল ঝরে পড়ে এবং ফলন ও অাঁশের মান অপরিবর্তিত থাকে। অন্যদিকে টাঙ্গাইলসহ কিছু কিছু এলাকার কৃষকরা বোরো ধান কেটে বৈশাখ মাসের শেষের দিকে কেনাফ চাষ করে থাকেন। কাজেই কেনাফ ফসলের বপনকালে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি এবং কৃষকরা সুবিধাজনক সময়ে কেনাফকে শস্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। শতকরা আশি ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন কেনাফ বীজ ১১ থেকে ১২ কেজি হেক্টরপ্রতি বপন করে ৪ মাসে ৩ থেকে ৩.৫ টন কেনাফ অাঁশ পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের বাজারে পাট ও কেনাফ অাঁশের দাম একই হওয়ায় কৃষকদের কাছে কম পরিচর্যায় অধিক ফলন প্রাপ্তিতে কেনাফের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে উন্নতমানের দেশীয় জাতের কেনাফ বীজ। চলতি উৎপাদন মৌসুমে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি উপজেলার গচিহাটা অ্যাকোয়াকালচার ফার্মস লিমিটেড তাদের কৃষি খামারে উৎপাদিত এইচসি-৯৫ জাতের ৬০০০ কেজি কেনাফ বীজ স্থানীয় কৃষকদের কাছে প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা হিসেবে বিক্রি করায় ৩৯ লাখ টাকা আয় করেছে। যদিও স্থানীয় বাজারে ভারতীয় কেনাফ বীজ ১৫০ টাকায় পাওয়া যায়, তারপরও ভালো ফলনের জন্য অধিক মূল্য দিয়ে দেশীয় জাতের বীজ সংগ্রহ করছে কৃষকরা। দেশীয় জাতের কেনাফের ফলন ও মান দুটোই ভালো এবং বীজের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে লাভজনক বীজ ফসল হিসেবে কেনাফকে শস্য বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করা গেলে বীজের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে। বিদেশে প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন ইনটেরিয়র কাজের ইনস্যুলেটর ছাড়াও জুটেক্স ও জিওটেক্সটাইল তৈরি এবং কেনাফ কাঠির ছাই থেকে চারকোল তৈরির নতুন সম্ভাবনা থাকায় কেনাফ চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নতুন দুয়ার খুলে যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, প্রজনন বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট