ড. মোঃ শহীদুর রশীদ ভুঁইয়াঃ বাংলাদেশের অধিকাংশ ভূমিই সমতল ও নিম্নাঞ্চল৷ এদেশে রয়েছে বহু নদী-নালা, খাল-বিল আর হাওড়-বাঁওড়৷ এসব জলজ পরিবেশে যেসব ফুল গাছ জন্মায় সেগুলোর প্রায় সবই বাংলাদেশ আর ভারতের নিজস্ব উদ্ভিদ৷ এই অঞ্চলের জল-হাওয়া আর মৃত্তিকায় এদের উত্পত্তি ঘটেছে৷ সে কারণেই এরা আমাদের একেবারে নিজস্ব ফুল৷ এদের কোন কোন ফুলের শোভা অত্যন্ত মনমুগ্ধকর৷
আজ প্রথম ফুলের পাব প্রসাদখানি, তাই ভোরে উঠেছি৷
আজ শুনতে পাব প্রথম আলোর বাণী, তাই বাইরে ছুটেছি
এই হল মোদের পাওয়া, তাই ধরেছি, গান-গাওয়া,
আজ লুটিয়ে হিরণ-কিরণ-পদ্মদলে সোনার রেণু লুটেছি
————– রবীন্দ্রনাথ
জলজ উদ্ভিদ দু’রকমের৷ মাটির সাথে সম্পর্ক রয়েছে তেমন জলজ উদ্ভিদই বেশি৷ এদের ভূ-আশ্রয়ী জলজ উদ্ভিদ বলা হয়৷ শাপলা-শালুক, লাল বা সাদা পদ্ম ফুল, রক্ত কমল, চাঁদ মালা এসবই ভূ-আশ্রয়ী স্বভাবের জলজ ফুল৷ পানির ভেতর দিয়ে এদের কান্ড চলে গেছে মাটির নীচ পর্যন্ত৷ ফুল তৈরি করে জলের উপর এবং মাটির সাথে কোন সংশ্রব নেই তেমন জলজ উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কচুরিপানা ফুল৷ কচুরিপানা ভিনদেশী এক জলজ পুষ্পক উদ্ভিদ৷
আমাদের বিল-ঝিল, পুকুর, খাল এসব জলাশয়ে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যে ফুল সেটি হলো শাপলা৷ নানা বর্ণের শাপলা রয়েছে- নীল, লাল, সাদা, নীল-সাদাটে ইত্যাদি৷ বর্ষার পানি বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে শাপলার নরম আর ফাঁফা কান্ডটিও৷ পানির উপর দান্ডয়মান শাপলা গাছের গোড়া কিন্তু পানির নিচে কাঁদার ভেতর৷ এর পানির উপর চমত্কার বিছিয়ে থাকে হৃদপিন্ড আকৃতির এক একটি বড় সড় পাতা৷ অযত্নে অবহেলায় বেড়ে বর্তে ওঠে আমাদের এই জলজ ফুল গাছটি৷
শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল৷ খরিফ মরসুমে এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ শাপলার কলি কেমন চমত্কার বোঁটায় বসা থাকে লম্বাটে সরু মাথা ডিমের মত হয়ে৷ অনেকগুলো সুগন্ধি পাপড়ির চমত্কার বিন্যাসে তৈরি শাপলা ফুল৷ মাঝখানে এর ভারী সুন্দর হলুদ পরাগ স্তবক৷ শাপলা ফুলের জীবনকাল প্রায় সপ্তাহখানেক৷ মজার বিষয় এই যে, শাপলা ফুল সব সময় খোলা অবস্থায় থাকে না৷ প্রতিদিনই কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এর পাপড়ি৷ আর সবচেয়ে মজার বিষয় এই যে, কোন ফুলের আজ যে পাপড়ি মেলে যে সময়, কাল সেই একই ফুলের পাপড়ি মেলবে ঠিক তার এক ঘন্টা পর৷
আবার আজ যে ফুলের পাপড়ি বন্ধ হয়েছে যে সময়, কাল সেই ফুলের পাপড়ি বন্ধ হবে এর এক ঘন্টা পর৷ গোলাকার ফল বীজে একেবারে ঠাসা৷ বীজ শুকিয়ে ভেজে নিলে সুন্দর খৈ তৈরি হয়৷ শাপলার নলের তরকারিও অনেকের বেশ প্রিয়৷ আজকাল শহরেও এর বেশ কদর বেড়েছে৷ সাদা শাপলা ফোটে রাতের সি্নগ্ধতায়৷ দিনের আলোয় আস্তে আস্তে এর পাপড়িগুলো বুজে যায়৷ এ কারণেই শাপলার আরেক নাম ‘কুমুদ’৷
জাতীয় ফুল শাপলা
শাপলারই এক আত্নীয় হলো নীল কমল৷ দেখতেও এদের মধ্যে ভারী মিল৷ নীল কমলের ফুলের বর্ণ হলো হালকা নীল৷ শাপলার মতো দেখতে আর একটি জলজ উদ্ভিদ হলো রক্তকমল৷ ফুলগুলো এর ১০-১৫ সেন্টিমিটার চওড়া৷ পাতাগুলো এর শাপলার চেয়ে একটু বড় বড়৷ আমাদের দেশের আর একটি প্রধান জলজ সপুষ্পক উদ্ভিদ হলো পদ্ম৷ পদ্ম হলো জলজ ফুলের রাণী৷ ভূ-আশ্রয়ী জলজ ফুল এটি৷ পানির উপর এর ফুল ফুটলেও এর মূল প্রোথিত মাটিতে৷ বাংলাদেশের গ্রামের ছেলে মেয়েদের অতি চেনা ফুল পদ্ম৷ এর পাতা গোলাকার, ভেসে থাকে পানির খানিকটা উপরেই৷ পদ্ম ফুলের বর্ণ হতে পারে লাল, নীল কিংবা সাদা৷ লাল দেখতে যে পদ্ম এর নাম লাল পদ্ম বা রক্ত পদ্ম৷ সাদা ফুলের পদ্মকে বলা হয় শ্বেত পদ্ম৷ কাশ্মীর আর ইরানের পদ্ম ফুল আবার নীল বর্ণের৷
পদ্ম ভারতের জাতীয় ফুল৷ ফুল ফোটে প্রধাণত শরত্কালে৷ কখনো আবার বর্ষাকালেও এর ফুলের দেখা মেলে৷ লম্বা বোঁটায় প্রজাতি ভেদে ফোটে লাল বা সাদা ফুল৷ অনেকগুলো পাপড়ি কি চমত্কার বিন্যাসে সজ্জিত বলে পদ্ম বড় হৃদয় কাঁড়ে৷ বেশ সুগন্ধি এদের ফুল৷ ফুলের বোঁটায় কাঁটার প্রতিরক্ষা বূ্যহ ভেদ করে তুলে আনতে হয় ফুল বা ফল৷ ফলের ভেতর বিদ্যমান বাদামি বীজগুলো ভক্ষণযোগ্য৷ সূর্য ওঠার সময় ফোটে বলে এদের নাম হলো পদ্ম৷ কাঁদার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এর ডগা এজন্য এর ডগার নাম মৃণাল৷ কাঁদা থেকে মৃণাল পানির ওপরে ওঠে এসে তৈরি করে পদ্ম গাছ৷ এজন্য এর নাম কমলও৷
পদ্ম
ভিক্টোরিয়া রিজিয়া হলো আরেক রকম পদ্ম৷ বিশাল বড় তার পাতা, ফুলও তাই৷ ফুল প্রায় প্রশস্তে এক ফুট আর পাতার প্রশস্ততা তিন-চার ফুট৷ এ কারণেই বাংলায় এর আরেক নাম দেও পদ্ম৷ পাতার কিনারা এমনভাবে উর্দ্ধপানে উথিত যে, যেন একটি বিশাল থালা ভেসে আছে পানিতে৷ কন্টকময় পাতা, বোঁটা এবং ফুলের বৃতাংশ৷ বড় গামলায় পানি ভরে দিয়ে একে লালন পালান করা চলে একটা সময় পর্যন্ত৷
মাখনা খানিকটা ছোট আকৃতির জলজ গাছই৷ গাছটি অনাকর্ষণীয় হলেও ফুলগুলো কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়৷ ছোট ছোট ফুল, চমত্কার নীল বা গোলাপী ফুল ভেসে থাকে পানির উপর৷ ফোটে শীতের শেষে৷ এদের পাতাগুলো কিন্তু বেশ বড়৷ চওড়ায় ৪০-৫০ সেন্টিমিটার৷ ফলের বাইরে কাঁটার প্রতিরক্ষা৷ তা সত্বেও ফলের বীজ বেশ লোভনীয় কারো কারো কাছে৷ লতানো জলজ উদ্ভিদ চাঁদ মালার গোল পাতা ভেসে থাকে পানির উপর৷ এদেশেরই জলজ উদ্ভিদ এটি৷ তৈরি করে ছোট ছোট সাদা ফুল৷ আর এদের ফলগুলো হলো গোল৷ পানশূল হলো আর একটি জলজ উদ্ভিদ৷ সাদা শাপলার মতো আকৃতি এদের ফুলের বটে তবে আকারে তারা খানিকটা ছোট৷
বর্ষাকালে বিল, পুকুর আর ডোবায় ফোটে বুনো কলমি লতার চমত্কার সব ফুল৷ কাদা পানি মিলে যে পরিবেশ সেখানে কলমিলতার ভালই গড়ে ওঠে সাম্রাজ্য৷ বেশ দ্রুতই জায়গা দখল করে নেয় এই লতানো স্বভাবের জলজ গাছটি৷ অনেক ফুল যখন এক সাথে ফোটে থাকে তখন তা বেশ মনমুগ্ধকর একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে৷ বেগুনি রঙের নলাকার এই ফুলের খুব একটা সমাদর না করলে সৌন্দর্য্য বিলিয়ে দিতে এর কোন কার্পণ্যতা নেই৷
বিদেশ থেকে সৌখিন কোন পুষ্প প্রেমিকের হাত ধরে এদেশে চলে এসেছে কচুরিপানা৷ একেবারে সূদুর ব্রাজিল থেকে এদেশে এসেছে এই গাছটি৷ ভারি চমত্কার এর পুষ্পমঞ্জুরি৷ ডাঁটায় ফোটা থাকা হালকা বেগুনি ফুলগুলোর রূপ বেশ চোখ জুড়ানো৷ দ্রুত বাড়ে বলে পুকুর আর বিলে এর বেশ দাপট৷ ফসলের মাঠ নষ্ট করে এরা দ্রুত বৃদ্ধি পায় বলে ফলে বদনাম এদের ভাগ্যে কম জোটিনি৷ অথচ এখন কত কাজেইনা লাগে এর পেলব এসব জলজ গাছ৷ পঁচিয়ে নিলে বেশ উত্তম সার হয় এরা৷ এখনতো কচুরিপানার উপর কচুরিপানা ফেলে তৈরি করা হয় ভাসমান ভেলার মত৷ তার উপর চলে কাঁদামাটির আস্তরণ দিয়ে ভাসমান সবজি চাষ৷ কচুরিপানার গাছ দিয়ে সবজির মাঠে এখন পানি ধরে রাখার কাজও করা হয়৷ লাউ গাছের গোড়ায় কচুরিপানার গাছ পানির উবে যাওয়া রোধ করতে বেশ দক্ষ বলে এদের বেশ কদর এখন৷ গবেষণা করলে আরো কত কাজে লাগতে পারে এ গাছ৷
কেবল স্থলে নয় জলেও হতে পারে চমত্কার উদ্যান৷ বড় বাগানের মাঝখানে একটি শান বাধানো পুকুর৷ পুকুরের স্বচ্ছ জলে শাপলা, শালুক এবং পদ্ম গাছে ফোটে আছে সাদা, লাল কিংবা অন্য কোন বর্ণের ফুল৷ শরত্কালে জলাভূমিতে ফোটে থাকা এসব ফুল মনের মধ্যে এক অন্য রকম অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে৷ বাগানের মাঝে এরকম একটি জলোদ্যান একেবারে বিরল নয় এদেশে৷ একটুখানি যত্ন আর মনযোগ দিলে দেশের বহু জলাশয়ে গড়ে তোলা যায় জলোদ্যান৷ সবচেয়ে কম পয়শায় একটুখানি মমতার পরশ তৈরি করতে পারে নান্দনিক শোভা৷
প্রফেসর, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ এবং প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা-১২০৭
কৃপ্র/এম ইসলাম