কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ দুধ ও মাংসের প্রয়োজন ও এর উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়টি সামপ্রতিককালে অতীব আলোচিত একটি বিষয়। উদ্ভুত সমস্যা উত্তরণের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই কাঁচা ঘাস উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। সেন্ট্রোসীমা এক জাতীয় উচ্চ ফলনশীল ঘাস। এই ঘাসটি একদিকে যেমন গবাদি পশুর জন্য উচ্চ পুষ্টি গুণসম্পন্ন অন্য দিকে আবার এর মাটির গুণগতমান বৃদ্ধিতে সহায়ক। সেন্ট্রোসীমা এক প্রকার লতানো ঘাস এবং এরা সীম বা লাউ গাছের মত উপরের দিকে লতিয়ে ওঠা পছন্দ করে। এটা লিগুম জাতীয় খরা সহিষ্ণু ঘাস এবং অল্প দিনের জন্য জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে অর্থাৎ যদি সীমিত সময়ের জন্য হয় তাহলে এ ঘাসের তেমন ক্ষতি হয় না। এই ঘাসটি লম্বায় প্রায় ৪ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। লতানো ঘাসটির মূলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুটি হয়। সেন্ট্রোসীমা সাধারণভাবে অন্যান্য ঘাসের সাথে একত্রে চাষ করাই সবচেয়ে ভালো।
জমি নির্বাচনঃ পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে এমন ধরনের উঁচু ও ঢালু জমি সেন্ট্রোসীমা চাষের জন্য উপযুক্ত । তাছাড়া বিভিন্ন জাতের স্থায়ী ঘাসের প্লট, বাঁধের ঢাল, বেড়া এবং আম-কাঠাল ইত্যাদির বাগানে এই ঘাস চাষ করা যেতে পারে।
বপন সময়ঃ বর্ষা মৌসুম অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে সেন্ট্রোসীমা বীজ বপনের সঠিক সময়। তবে আগষ্ট মাস পর্যন্ত এর বীজ বপন করা যেতে পারে।
বংশ বিস্তারঃ এটি লিগুম জাতীয় ঘাস। বীজের মাধ্যমে এর বংশ বিস্তার হয়। প্রতি একরে ৩-৪ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি চাষ ও বপন পদ্ধতিঃ সেন্ট্রোসীমা ঘাস বিভিন্ন স্থায়ী ঘাসের সাথে সাথী ঘাস হিসাবে বপন করাই শ্রেয়। নেপিয়ার, গিনি ইত্যাদি স্থায়ী ঘাসের সাথে বপন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে দুই লাইনের মধ্যবর্তী স্থানে জমির মাটি আলগা করে ২/৩ সেমি গভীর গর্তে বীজ বপন করতে হয়। বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে এই ঘাস চাষ করতে হলে ভালোভাবে জমি চাষ করে এবং মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। হাত লাঙ্গল দিয়ে ৩.২৫ ফুট দূরত্বে ১ ইঞ্চি গভীর গর্ত করে ১-১.৫০ ইঞ্চি পর পর বীজ বপন করতে হয়। ঘাস বড় হতে শুরু করলে মাচা করে দিতে হবে। বাড়ীর আশে-পাশে বা বেড়ার পাশে ছিটিয়েও এই ঘাস লাগানো যেতে পারে। বেড়ার পাশে এক ফুট প্রস্থে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ভালভাবে জমি তৈরি করতে হবে। এই ঘাস বেড়া পেঁচিয়ে বড় হতে থাকে। প্রথম ৩/৪ সপ্তাহ এটা খুব ধীর গতিতে বৃদ্ধি পায়, সেকারণে এসময়ে সঠিক যত্ন নিতে হবে। গাছের গোড়ায় নিড়ানী দিয়ে আগাছামুক্ত করে দিতে হবে।
সার প্রয়োগঃ যখন অন্যান্য স্থায়ী ঘাসের সাথে এটা চাষ করা হয়, তখন বাড়তি সারের দরকার হয় না। তবে বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এককভাবে চাষ করা হলে একর প্রতি ২০ কেজি ইউরিয়া, ৫০ কেজি টিএসপি সার দিতে হবে। জমি তৈরির পূর্বে জমিতে টিএসপি সার এবং চারা গজানোর পরে ইউরিয়া সার দিতে হবে। উল্লেখ্য, জমি তৈরির পূর্বে যদি গোবর বা মুরগির বিষ্ঠা যথেষ্ট পরিমাণে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে রাসায়নিক সার কম প্রয়োজন হয়।সেন্ট্রোসীমা বছরে একর প্রতি ১৬-২০ টন পর্যন্ত সবুজ ঘাস উৎপাদন করা সম্ভব।
ঘাস খাওয়ানোর নিয়মঃ সাধারণত সেন্ট্রোসীমা কাঁচা ঘাস হিসাবে সরাসরি অথবা কেটে টুকরা টুকরা করে খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। যদি একটি গাভীর দৈহিক ওজন ১০০ কেজি হয় তাহলে এর দৈনিক খাদ্য তালিকায় ০.৭৫ কেজি দানাদার খাদ্য, ১ কেজি শুকনা খড় এবং ৪-৪১/২ কেজি সেন্ট্রোসীমা কাঁচা ঘাস দিতে হবে। তবে যদি এই গাভীটিকে (১০০ কেজি ওজনের) ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় খাওয়ানো হয়, সেক্ষেত্রে ০.৫০ কেজি দানাদার, ২-৩ কেজি সবুজ সেন্ট্রোসীমা, ০.৫ কেজি শুকনা খড় এবং ২-২.৫ কেজি ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় প্রতিদিন সরবরাহ করতে হবে। এই হিসাব গাভীর ওজন অনুপাতে প্রয়োজনীয় খাদ্যের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করে এর অর্ধেক সকালে এবং বাকী অর্ধেক বিকালে খাওয়াতে হবে।
ঘাস সংরক্ষণ পদ্ধতিঃ সেন্ট্রোসীমায় ফল ধরা শুরু হওয়ার সময় কেটে রৌদ্রে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। এর জন্য এই ঘাসকে ২/৩ দিন রৌদ্রে ভালভাবে শুকাতে হয়। শুকানোর সময় বাঁশের আড়া দিয়ে দিনে ৩/৪ বার নেড়ে দিতে হবে। শুকানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে এতে যেন কোনক্রমেই ১৫% এর বেশি আর্দ্রতা (পানি) না থাকে। তাই ঘাস শুকানোর দিকে যথেষ্ট সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ঘাস সঠিকভাবে শুকালো কিনা তা জানার জন্য এক মুঠা ঘাস হাতে নিয়ে চাপ দিলে যদি পুরাপুরি ভেঙ্গে না যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘাস শুকানো সঠিক হয়েছে। এ অবস্থায় ঘরে গাদা করে রেখে দিলে তা দীর্ঘদিন সংরক্ষিত থাকবে।
সেন্ট্রোসীমা ঘাসের উপকারিতাঃ আমিষ, খনিজ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ গো-খাদ্য পাওয়া যায়। গাভীকে সবুজ সেন্ট্রোসীমা খাওয়ানো হলে দুধ উৎপাদন প্রায় ২০% বৃদ্ধি পায়। এই ঘাসের শিকড়ে প্রচুর সংখ্যক গুটি জন্মে যা বাতাসের নাইট্রোজেনকে ধারণ করে রাখে। পরবর্তীতে এসব শিকড় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এই লিগুম ঘাস একদিকে যেমন মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে তেমনি গাভীকে খাওয়ানোর পর গাভীর দুধ উৎপাদনও বৃদ্ধি করে।
কৃপ্র/এম ইসলাম