কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ গত সাত বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে, সঙ্গে মৃত্যুর হারও বাড়ছে। দেশে বজ্রপাতের ঝুঁকি ভয়ানকরূপ ধারণ করেছে। এ সময়ের মধ্যে চলতি বছরের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত এক হাজার ৭৪৪ জন ব্যক্তির বজ্রপাতজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে। বিশ্লেষকগণ বলছেন, বিশ্ব জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত বিষয়টি ঘন ঘন বা বেশি মাত্রায় বজ্রপাতের অন্যতম কারণ। আগে তাল গাছ, নারিকেল গাছ ইত্যাদি গাছ পালায় বজ্রপাতের ঘটনা বেশি লক্ষ্য করা যেত।
বাংলাদেশে হাওর এলাকা এখন বজ্রপাতের প্রধান ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কারণ গত কয়েক বছরে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে বজ্রপাতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বেশি। এ বিষয়ে সরকারের প্রস্তুতিও চলছে। ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম থেকে কিছু কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। প্রশিক্ষিত কর্মকর্তারা একটি প্রকল্প তৈরির কাজে নিয়োজিত আছেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকাসহ চিহ্নিত কিছু জায়গায় বাড়ির ছাদে বজ্রপ্রতিরোধক টাওয়ার স্থাপন করা হবে। ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-আইনে এই ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করে বিধান রাখার নির্দেশনা দেওয়া হবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, ভিয়েতনাম থেকে বজ্রপাত নিরোধকারী ও আগাম সংকেত প্রদানযোগ্য যন্ত্রাংশ আনার পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো আসলে নির্ধারিত প্রকল্পের অধীনে বজ্রপাত নিরোধে প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শুরু হবে। মন্ত্রী বলেন, এখন দেশে বিশেষ করে ফাঁকা অঞ্চলে ১০ লাখ তাল গাছ লাগানোর কাজ চলছে। এ ছাড়া ব্যাপক বনায়নকেও বজ্রপাতের ঝুকি হ্রাসের পক্ষে কার্যকর বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সে কাজেও পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকেও বনায়নে কাজ করা হবে।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, দেশের হাওর অঞ্চলে জরুরী ভিত্তিতে বজ্রনিরোধক টাওয়ার নির্মাণ বা স্থাপন করা হবে। বাসা-বাড়ির ছাদেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই কাজ করা হবে। বিশেষজ্ঞ মতামত উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, অধিকমাত্রায় বজ্রপাত প্রাকৃতিক দুর্যোগে নতুন মাত্রা। যেটি আমাদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। সচিব জানান, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত নেয়া হয়েছে। সেখানে তারা বজ্রপাতের মতো পরিবেশ যেমন আকাশ মেঘাছন্ন হয়ে আসা, বৃষ্টি হতে পারে এমন আবাওয়া তৈরি হওয়া দেখলে নিরাপদ অবস্থান গ্রহণ করা শ্রেয়। দ্রুত ফাঁকা জায়গা ত্যাগ করা, কোনো ধরনের গাছগাছালির নিচে অবস্থান না করা, উঁচু ভবনের ফাঁকা ছাদে না থাকা অপেক্ষাকৃত নিচু ঘরে অবস্থান করা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে- গত ২২ এপ্রিল পর্যন্ত চলতি বছর দেশে বজ্রপাতে ২২ জন মারা গেছেন। তবে ডিজাস্টার ফোরাম নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারাদেশে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৭২২ জন। এরমধ্যে ২০১০ সালে ১২৩ জন, ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ১২ সালে ৩০১ জন, ১৩ সালে ২৮৫ জন, ১৪ সালে ২১০ জন, ১৫ সালে ২৭৮ জন এবং ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৩৫০ জন নিহত হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ও জলবায়ু বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক নঈম গওহর ওয়ারা ‘ইত্তেফাক’কে বজ্রপাতের বিষয়ে সতর্কতামূলক বেশ কিছু পরামর্শ অনুসরণের নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, এখন থেকে পরবর্তী তিন মাস (আগামী জুলাই পর্যন্ত) বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। গত ছয় বছরের তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর ১১৭ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
পানি থেকে দূরে থাকা, বজ্রপাতসহ ঝড়ের সম্ভাবনা থাকলে নৌকা বা স্টিমারে ভ্রমণ করা অথবা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা। ঝড়ের সময় পানিতে থাকলে, যত দ্রুত সম্ভব পার্শ্ববর্তী শুকনো স্থানে যাওয়া। বিদ্যুত্ পরিবাহী এমন বস্ত্র কিংবা যন্ত্র যেমন ট্রাক্টর, লোহার লাঙল, বাইসাইকেল, মোটর সাইকেল থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অবস্থান করা। খোলা জায়গায় অবস্থানকালে উঁচু স্থান এড়িয়ে চলা। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভিতর অবস্থান নিরাপদ; কিন্তু গাড়ি যেন বৈদ্যুতিক সংযোগ আছে এমন স্থাপনার সংস্পর্শে না থাকে। বন বা জঙ্গলে অবস্থান কালে তুলনামূলকভাবে নিচু জায়গায় যেখানে অল্প গাছপালা বা ঝোপ আছে সেখানে আশ্রয় নেয়া, মোটর সাইকেল বা বাইসাইকেলে চলমান থাকলে দ্রুত থেমে যাওয়া, বজ্রপাতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নেয়া।
ঘরের ভিতর অবস্থানকালে ঝড় আসার পূর্বে সকল বৈদ্যুতিক যন্ত্র (টিভি, ফ্যান, ফ্রিজ, কম্পিউটার) ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, বাড়ির সবচেয়ে ভিতরের দিকে অবস্থান করা, বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা টেলিফোন ব্যবহার পরিহার, শুধু ব্যাটারি চালিত যন্ত্র ব্যবহার করা। বজ্রপাতজনিত ক্ষতি কমানোর জন্য বজ্রনিরোধক দণ্ড ও আর্থিং ব্যবস্থা খুবই কার্যকর এবং স্বল্প খরচের।
সুত্রঃ ইত্তেফাক / কৃপ্র/এম ইসলাম