কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ পারা ঘাস একটি উচ্চ উৎপাদনশীল ঘাস। এ ঘাস বিভিন্ন নাম যেমন মহিষ ঘাস, পানি ঘাস ইত্যাদি হিসাবে পরিচিত। এ ঘাস জমিতে চাষের পর মাটিতে লতার মত ছড়িয়ে পড়ে এবং অল্প দিনেই সমস্ত জমিতে বিস্তারলাভ করে। এ ঘাসের উৎপত্তি আমেরিকায় হলেও বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত ও বিশ্বের অন্যান্য স্থানের আবহাওয়ায় আবাদ বা চাষযোগ্য। জমিতে একবার রোপন করলে কয়েক বছর পর্যন্ত বিনা চাষে ফলন পাওয়া যায়।
জমি নির্বাচন
পারা ঘাস প্রায় সব ধরনের জমি যেমন উঁচু, নিচু, ঢালু, জলাবদ্ধ এমনকি লোনা মাটিতেও চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় প্রায় সর্বত্রই এর ফলন বেশ সন্তোষজনক। গাছের নীচে, অধিক স্যাঁতস্যাঁতে, জলাবদ্ধ এবং বন্যা প্লাবিত জমি যেখানে অন্যান্য ফসল মোটেই ভাল জন্মে না সেখানে পারা চাষ করে অধিক ফলন পাওয়া যায়। তবে পারা বেশি শীত সহ্য করতে পারে না। যে সব এলাকায় বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ১০০ সেমি-এর কম সেখানে পারা উৎপাদন ঠিক নয়।
রোপন সময়
বৈশাখ হতে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পারা ঘাস রোপনের উত্তম সময়। কিন্তু জমি ভিজা বা পানি সেচ দেয়ার সুবিধা থাকলে চৈত্র মাসেও এ ঘাস চাষ করা যায়। পারা ঘাস কাটিং বীজ হিসাবে শিকড়সহ গাছ বা কান্ড ব্যবহৃত হয়। প্রত্যেক কাটিং বা চারায় ২ বা ৩টি গিটসহ প্রতি ২.৫ একরে ছিটিয়ে বপনের জন্য ১০০০ কেজি দরকার। আর যদি সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়, তাহলে ২.৫ একর প্রতি ১২০০ কেজি কাটিং-এর প্রয়োজন হয়।
জমি চাষ ও রোপন পদ্ধতি
জমিতে কমপক্ষে ২-৩টা চাষের প্রয়োজন হয়। জমি ভালমত চাষ এবং আগাছা পরিষ্কার করে এই ঘাস বপন করলে খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় এবং ফলন বেশি হয়। যদি জমি ভিজা থাকে তাহলে চারা মাটিতে ফেলে লাগানো যায়। আর যদি জমিতে পানি থাকে তাহলে কাটিং-এর মাথা (হেলান ভাবে) লাগাতে হবে। সারিবদ্ধভাবে লাগানোর ক্ষেত্রে এক সারি হতে অন্য সারির দূরত্ব ২৪-৩৬ ইঞ্চি এবং এক চারা হতে অন্য চারার দূরত্ব ৬-১২ ইঞ্চি হতে হবে।
সার প্রয়োগ
পারার ক্ষেতে সার প্রয়োগ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। পারা দ্রুত বর্ধনশীল এবং বছরে অনেকবার কাটা যায়। এ ঘাসের জন্য সারের চাহিদা নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া। সমতল চাষযোগ্য জমিতে পারা চাষের জন্য জমি প্রস্তুতির সময় প্রতি ২.৫ একরে ১০/১২ মে.টন গোবর সার এবং ৮৫ কেজি টিএসপি সার দিতে হবে। ঘাস লাগানোর ২/৩ সপ্তাহ পর প্রতি ২.৫ একরে ৮৫ কেজি ইউরিয়া দিতে হবে। তাছাড়া প্রতি বার ঘাস কাটার পর ৮৫ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ভাল হয়। এ ঘাসের জমি সব সময় স্যাঁতস্যাঁতে বা ভিজা রাখতে পারলে ভাল হয়। তাই বছরের শুকনা মৌসুমে পানি সেচ করা প্রয়োজন।
পারা ঘাসের তেমন একটা যত্নের প্রয়োজন হয় না। তবে সঠিক সময়ে ঘাস কাটলে এবং পানি সেচ ও সার প্রয়োগ করতে পারলে এই ঘাস পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হয়। প্রতিবার ঘাস কাটার পর জমিতে হালকা চাষ দিয়ে মাটি নরম করে দিতে হবে। ভালভাবে আগাছা পরিষ্কার করে প্রতি ২.৫ একরে ৮৫ কেজি এমোনিয়াম সালফেট সার দিলে প্রত্যাশানুযায়ী ফলন পাওয়া যায়। যদি পারা ঘাস জলাবদ্ধ জমিতে চাষ করা হয় তাহলে কোনো প্রকার লিগুম ঘাসের সাথে চাষ করা যায় না। তবে উঁচু জমিতে চাষ করা হলে সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের লিগুম ঘাস যেমন সেন্ট্রোসীমা, নিরাট্রো ইত্যাদি সাথী হিসাবে চাষ করা যায়। পারা ঘাস লতিয়ে যায় বলে অল্প দিনের মধ্যেই জমিতে ছড়িয়ে পড়ে। ঘাস রোপনের তিন মাস পর প্রথম বার ঘাস কাটা যায় অথবা গবাদি পশুকে চরিয়ে খাওয়ানোর উপযোগী হয়। বৎসরে প্রায় ৮/১০ বার ঘাস কাটা যায়। প্রয়োজনানুযায়ী সার ও পানি সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে বৎসরে প্রতি ২.৫ একর ৯০-১০০ মে. টনের মত সবুজ ঘাস পাওয়া যায়।
ঘাস খাওয়ানোর নিয়ম
এ ঘাস মাঠ থেকে কেটে এনে খাওয়ানোই উত্তম। এক্ষেত্রে টুকরা টুকরা করে কেটে খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো ভালো। যদি একটি গাভীর দৈহিক ওজন ১০০ কেজি হয়, তাহলে এর দৈনিক খাদ্য তালিকায় ১.০ কেজি দানাদার খাদ্য ১.৪০ কেজি শুকনা খড় এবং প্রায় ৪.০ কেজি পারা ঘাস সরবরাহ করা যেতে পারে। তবে যদি এই গাভীকে (১০০ কেজি ওজনের) ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় খাওয়ানো হয়, সেক্ষেত্রে ০.৫ কেজি দানাদার খাদ্য ১.০ কেজি শুকনা খড়, ২.৫-৩.০ কেজি পারা ঘাস এবং ২-২.৫ কেজি ইউরিয়া মোলাসেস মিশ্রিত খড় প্রতিদিন সরবরাহ করা যেতে পারে।
সংরক্ষণ
পারা ঘাস শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। তবে সাইলেজ হিসাবে সংরক্ষণ করাই উত্তম। গাভীর দুধ উৎপাদন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য কাঁচা ঘাসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কাঁচা ঘাসের সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া মাংস ও দুধ উৎপাদন বাড়ানো প্রায় অসম্ভব। সেদিক বিবেচনা করলে উচ্চ ফলনশীল ঘাস হিসাবে পারা ঘাস বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে চাষ করা যেতে পারে।
কৃপ্র/এম ইসলাম