কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সিলেটের চা বাগান ও হাওড়াঞ্চলে বাড়ছে কুষ্ঠরোগ। তবে এ অঞ্চলের চা শ্রমিকদের মধ্যে রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। সংশ্লিষ্টদের মতে, চা শ্রমিকদের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস ও অপুষ্টিই এর প্রধান কারণ। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে সিলেট বিভাগে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৬৭ জন। এর মধ্যে চা বাগান অধ্যুষিত মৌলভীবাজারেই আক্রান্ত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি, ২৯৪ জন। এছাড়া হবিগঞ্জে ৩৮, সুনামগঞ্জে ১৯ ও সিলেটে ১২ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আর চলতি বছর নতুন করে আরো অর্ধশতাধিক কুষ্ঠরোগী শনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তবে বেসরকারি হিসাবে কুষ্ঠরোগে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি, যাদের অধিকাংশই চিকিত্সার আওতায় আনা যায়নি। জানা যায়, সিলেট জেলার মধ্যে রোগটিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যা ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায়। আর সিলেট জেলায় সবচেয়ে বেশি চা বাগান রয়েছে এ উপজেলায়ই।
সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চা বাগান ও হাওড়বেষ্টিত অঞ্চল হওয়ায় সিলেটে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা চা শ্রমিকরা অপুষ্টিজনিত কারণে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকার সারা দেশে ১৯৯৮ সালের মধ্যে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা প্রতি ১০ হাজারে একজনে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। সারা দেশে এ লক্ষ্য অর্জিত হলেও সিলেটে তা সম্ভব হয়নি। এজন্য গত বছর সিলেট অঞ্চলে পাঁচ বছরমেয়াদি বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া হয়। এতে ২০২০ সালের মধ্যে সিলেটে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চা বাগানের শ্রমিক ও হাওড়াঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও চিকিত্সাসেবা পৌঁছানোর মধ্য দিয়ে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
১৯৯০ সালে নগরীর শেখঘাটে নির্মিত হয় সিলেট কুষ্ঠ হাসপাতাল। এ হাসপাতালে গিয়ে কথা হয় মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার একটি চা বাগানের শ্রমিক রিপন গোয়ালার সঙ্গে। প্রায় ১২ দিন ধরে এ হাসপাতালে চিকিত্সা নিচ্ছেন তিনি। রিপন জানান, বছর দুয়েক আগে তার হাত-পায়ে হঠাত্ চর্মরোগ দেখা দেয়। পরে আস্তে আস্তে তাতে পচন শুরু হয়। প্রথমে বাগানের চিকিত্সকদের কাছে চিকিত্সা নেন। পরে এ হাসপাতালে আসেন তিনি। মৌলভীবাজারের বাগানগুলোয় এমন রোগে অনেকেই আক্রান্ত হন বলে জানান রিপন। তবে সেখানে কুষ্ঠ চিকিত্সার কোনো সুযোগ নেই। আর দূরে হওয়ায় অনেকেই সিলেটের হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে আসেন না। অনেকে হাসপাতালটির তথ্যও জানে না বলে জানান তিনি।
সিলেট কুষ্ঠ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. রুবিনা ফারজানা বলেন, ‘মূলত অপুষ্টি ও সচেতনতার অভাবে সিলেটে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। চা বাগান ও হাওড়াঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষই অপুষ্টির শিকার। ফলে এসব অঞ্চলেই রোগটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।’ এ হাসপাতালে চিকিত্সা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগীই চা শ্রমিক বলে জানান তিনি।
সিলেটের হাওড় ও চা বাগানের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিয়া। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নজমুল হক বলেন, ‘পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, চা শ্রমিকরা যে মজুরি পান, তাতে তাদের ঠিকমতো দুবেলা খাবারই জোটে না।’ তিনি বলেন, ‘কুষ্ঠরোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিত্সকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, চা বাগান ও হাওড়গুলোয় চিকিত্সাসেবা খুবই দুষ্প্রাপ্য। চিকিত্সক নেই বললেই চলে; এর সঙ্গে রয়েছে অর্থাভাব। ফলে এ অঞ্চলে কুষ্ঠ নিরাময় সম্ভব হচ্ছে না।’
সিলেট বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. ইসমাইল ফারুক বলেন, ‘মূলত চা বাগানের আধিক্যের কারণেই সিলেটে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া হাওড় এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এ রোগের আধিক্য দেখা যায়।’
সিলেটের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সিলেটে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। আমরা ২০২০ সালের মধ্যে রোগটি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এ লক্ষ্যে চা বাগান ও হাওড় এলাকায় সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করা হচ্ছে।’ তিনি আরো জানান, প্রথমে চর্মরোগ দিয়ে শুরু হলেও ধীরে ধীরে এ রোগে আক্রান্তে হাত-পা পচে যায়। পুষ্টিকর খাবার, সময়মতো চিকিত্সা ও সচেতন হলে এ রোগ নিরাময় সম্ভব।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম