‘অধিকাংশ মুরগি খামারই এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ২০১২ সালের জানুয়ারিতে এক হাজার ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা নিয়ে খামার গড়ে তোলেন লক্ষ্মীপুরের নুর মোহাম্মদ রিপন। প্রথমবারই প্রায় ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয় তার। পরবর্তী সময়ে ব্যবসার পরিধি বাড়িয়ে ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি জাতের মুরগির প্রায় ৩০টি খামার গড়ে তোলেন তিনি। কিন্তু মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে লোকসানে পড়ে তাকে ২০টি খামারই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। রিপনের মতো আরেক ভুক্তভোগী মো. জাহাঙ্গীর আলম জয়। সাড়ে চার একর জমির ওপর গড়ে তোলা তার খামারের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় কোটি টাকা। কিন্তু বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে বিপাকে পড়েছেন তিনিও। এভাবে জেলার অধিকাংশ মুরগি খামারই এখন বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রতিবেদন দৈনিক বনিক বার্তা।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় দেড় হাজারের বেশি মুরগির খামার রয়েছে। তাদের অভিযোগ, খাদ্য ও বাচ্চা উত্পাদনকারী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধি করছেন। এতে তাদের লোকসান বাড়ছে। তাছাড়া প্রাণিসম্পদ অফিস থেকেও পরামর্শ কিংবা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। ফলে তাদের অধিকাংশ খামারই এখন বন্ধ হওয়ার পথে।
তবে খামারিদের তথ্যের মিল পাওয়া যায়নি জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের হিসাবে। সরকারি দপ্তরটির তথ্যমতে, বর্তমানে লক্ষ্মীপুরের পাঁচ উপজেলায় মোট ১ হাজার ৩১টি মুরগির খামার রয়েছে। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশনকৃত খামারের সংখ্যা ৯২২টি ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন খামারের সংখ্যা ১০৯টি। ২০১৬ সালের জুনে জেলায় ১ হাজার ২৮টি, ২০১৫ ও ২০১৪ সালে ১ হাজার ৩২টি এবং ২০১৩ সালে ৯৭৬টি খামার ছিল। তবে এ হিসাবের বাইরেও মুরগির খামার রয়েছে, যেগুলো বার্ষিক তথ্যের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে স্বীকার করেন জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান, জনবল সংকটের কারণে মাঠপর্যায়ে গিয়ে খামারিদের তথ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। আগের বছরের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে উপজেলা অফিসের পাঠানো রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে পুরো জেলার তথ্য তৈরি করা হয়।
জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের সংস্থাপন কর্মকর্তা মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, এ অফিসের বেশির ভাগ পদই শূন্য। তাই মাঠপর্যায়ে খামারিদের তদরাকি করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একদিনের বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বাড়ায় অধিকাংশ খামার লোকসানের মুখে পড়ে এখন বন্ধের পথে বলে জানান তিনি। জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে লেয়ার, ব্রয়লার ও সোনালি— এ তিন জাতের মুরগি বাণিজ্যিকভাবে পালন করা হয়। দুই বছর আগে একদিন বয়সের লেয়ার মুরগির বাচ্চা ৩০-৩৫ টাকা বিক্রি হলেও বতর্মানে তা ১০০-১১০ টাকা। একইভাবে দুই বছর আগে একদিন বয়সী ব্রয়লারের বাচ্চা ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হলেও বতর্মানে দাম ৭০-৮০ টাকা। এ সময়ে সোনালি জাতের বাচ্চার দাম ১২-১৫ থেকে ৩৫-৪০ টাকা হয়েছে। দুই বছর আগে মুরগির প্রতি বস্তা খাদ্যের দাম ছিল ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। বর্তমানে এ খাদ্য ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খামারিদের অভিযোগ, খাদ্য ও বাচ্চা উত্পাদক থেকে খামারির হাতে পৌঁছাতে কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। এ কারণে দাম কয়েক গুণ বেড়ে যায়। আবার কিছু অসাধু প্রতিষ্ঠান খাদ্য ও বাচ্চা উত্পাদনের পাশাপাশি নিজেরাই মুরগির খামার করছে। এসব খামারে উত্পাদিত ডিম ও মুরগি বাজারে কম মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে ক্ষুদ্র খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
জোহান পোলট্রি কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জয় বলেন, হ্যাচারিতে ৬ টাকা মূল্যের একটি ডিম থেকে বাচ্চা উত্পাদনে খরচ হয় ২ টাকা। এ হিসাবে বাজারে ২০-২৫ টাকা বিক্রি হলেও চলে। কিন্তু এ বাচ্চা বর্তমান বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৭০ থেকে ১২০ টাকায়।
তিনি বলেন, খামারে ১০ হাজার লেয়ার মুরগিকে দৈনিক ২৪ বস্তা করে খাদ্য দিতে হয়। এসব মুরগি দৈনিক আট হাজার করে ১৮ মাসে (দেড় বছর) ৪৩ লাখ ৮০ হাজার ডিম দেবে। খাদ্যের দাম বাড়াতে প্রতিটি ডিম উত্পাদনে প্রায় ৬ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যায়। অথচ ডিম বিক্রি হয় ৫ দশমিক ২৫ টাকায়। উত্পাদন খরচের তুলনায় কম দামে ডিম সরবরাহ করে দৈনিক প্রায় ১০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের মূল্য নির্ধারণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
নুর মোহাম্মদ রিপন জানান, বর্তমানে তার একটি লেয়ার, চারটি ব্রয়লার ও পাঁচটি সোনালি জাতের মুরগির খামার রয়েছে। এসব খামারে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ২৪ লাখ টাকা। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে এ ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।
টুমচর এলাকার কুয়েত প্রবাসী আবু তাহের দেশে ফিরে লাভের আশায় ব্রয়লার খামার করেন। তিনি জানান, ব্রয়লার মুরগি পালন করে প্রথম বেশ লাভ হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সবকিছুর দাম বাড়তি। খামারে এক হাজার ব্রয়লার মুরগি রয়েছে। একটি মুরগি উত্পাদনে খরচ পড়ে ১৮৫-১৯০ টাকা। অথচ তা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়। এতে করে প্রতিটি মুরগিতে লোকসান হচ্ছে ৩০ টাকা পর্যন্ত।
মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে নিয়মিত সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন ক্ষতিগ্রস্ত খামারিরা। ১ মে উত্তর তেমুহনী এলাকায় পোলট্রি খামার মালিক সমিতির উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। সমাবেশে খামারিরা একদিনের বাচ্চা ও খাদ্যের মূল্যহ্রাসের দাবি জানান।
মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের ডিলার ভাই ভাই পোলট্রি ফিডের স্বত্বাধিকারী মো. বেল্লাল হোসেন জানান, বাজারে মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। বতর্মানে কাজী ফার্মের এক দিনের ব্রয়লার বাচ্চা ৮০ টাকা ও নাহার এগ্রোর ৮২ টাকায় এবং লেয়ার মুরগির বাচ্চা ১০৫-১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি বস্তা খাদ্য ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি জানান, বাচ্চা ও খাদ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে খামারিরা লোকসান গুনছে। এ কারণে তার ১০ জনের মতো গ্রাহক (খামারি) মুরগি পালন বন্ধ করে দিয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর সদর থানা পোলট্রি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তানভীর আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, বাচ্চা ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সদর উপজেলার প্রায় ১০০ খামারি লোকসানের মুখে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের দাম আরো বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা পোলট্রি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাইনূর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জেলার ১ হাজার ৫০০ খামারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক খামারে এখন উত্পাদন বন্ধ। মুরগির বাচ্চা ও ফিড ডিলাররাও এ কারণে লোকসান গুনছেন।
সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. তারানা আহমেদ জানান, উপজেলায় ব্রয়লার ২২৯টি ও লেয়ার ৪৭টি মিলে মোট ২৭৬টি মুরগির খামার রয়েছে। মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খামারিদের লোকসান হচ্ছে। এতে আমাদের কিছু করার নেই। তবে বিষয়টি জেলা অফিসকে অবহিত করা হয়েছে।
জানতে চাইলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, লক্ষ্মীপুরে পোলট্রি খামারের জন্য উপযুক্ত স্থান। এখানে রোগবালাইও কম আক্রমণ করে। তবে জনবলের অভাবে খামারগুলো ঠিকমতো তদারকি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, মুরগির বাচ্চা ও খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে দিন দিন খামারিরা মুরগি পালনে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা নেয়া হলে খামারিরা লোকসান পুষিয়ে উঠতে পারবেন।
কৃপ্র/এম ইসলাম