কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন আমবাগানে ব্যবহৃত হচ্ছে ‘কালটার’ নামে একধরনের কিটনাশক । চোরাই পথে এই রাসায়নিকটি পাচার হয়ে আমাদের দেশে আসছে । এটা ব্যবহারে প্রথম দু-তিন বছর গাছে আমের ভালো ফলন হচ্ছে। কিন্তু এর পরে আমগাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে, ফলের আকার ছোট হয়ে ওজনও কমে যাচ্ছে। জাতীয় বৃক্ষ আমগাছের ভবিষ্যৎ নিয়ে এমন আশঙ্কা জানিয়ে গত ৩১ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হামিম রাজা ও শরফ উদ্দিন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে এই অভিমত তুলে ধরেছেন।
তাঁরা বলছেন, কালটার ব্যবহারের কারণে গত মৌসুমে অনেক নামকরা বাগানের আমগাছে কোনো মুকুল আসেনি, যা আমচাষি ও বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। এর ব্যবহার অব্যাহত থাকলে এই এলাকার আমবাগান রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। এই ক্ষতি পোষাতে গাছের দীর্ঘমেয়াদি পরিচর্যার প্রয়োজন বলে তাঁরা মনে করছেন। কালটার বা প্যাকলোবিউট্রাজল উদ্ভিদের একধরনের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক। এটি তরল বা পাউডার উভয় অবস্থাতেই পাওয়া যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে করা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে এই রাসায়নিক প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে অবৈধভাবে কেউ কেউ এনে আমগাছে প্রয়োগ করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, ১০ বছরের কম বয়সী আমগাছে কালটার ব্যবহার করলে ওই গাছ দু-তিন বছর পর ধীরে ধীরে মারা যাবে। আর ১০ বছরের বেশি বয়সী গাছেও যদি অপরিমিত পরিমাণে ব্যবহার করা হয়, তাহলেও গাছের ক্ষতি হবে। আমের ফলন পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। তাই এটি যাতে কৃষকেরা ব্যবহার না করেন, সে জন্য আম চাষ হয় এমন জেলাগুলোতে কর্মশালা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি প্রচারপত্র তৈরি করা হয়েছে।
এর আগে এ বছরের শুরুর দিকে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় কালটার ব্যবহারের ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রতিবেদন দেয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শিল্প মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত ৩ মে দেশীয় আমের বাজারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা প্রসঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয় বিএসটিআইকে একটি চিঠি দেয়। সেখানেও কালটার ব্যবহারে আমগাছ ও ফলনের ক্ষতির বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, এটি ব্যবহারে স্বল্প মেয়াদে ফলের উৎপাদন বাড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে কমে যায়। গাছের পাতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে ঝরে যায়, ডাল মরে যায়। চূড়ান্তভাবে গাছ মারা যায়।
গত মাসের শুরুতে আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বেশ কিছু আমবাগান ঘুরে কালটার ব্যবহারের বিষয়টি দেখা গেছে। শিবগঞ্জের সৎরাজিপুর ইউনিয়নের প্রধান সড়কের ভাঙারির দোকানে স্তূপাকারে কালটারের অনেক বোতলের হদিস পাওয়া যায়। বেশ কয়েকটি বাগানে গাছের চারপাশে পরিখার মতো নালা দেখা যায়। পরে বেশ কয়েকজন চাষি বলেন, এই নালার ভেতর কালটার দেওয়া হয়। অনেক আমবাগানে কালটার ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত কয়েক বছরের জন্য আমবাগান ইজারা নেন এমন চাষিরা দ্রুত লাভের আশায় কালটার ব্যবহার করে থাকেন। এতে প্রথম দু-তিন বছর খুব ভালো ফলন হয়। দ্রুত মুকুল ও গুটি ধরে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের আমচাষি ইসমাইল খান শামিম জানালেন, তিনি দুই বছর আগে এক ব্যবসায়ীকে তাঁর বাগান ইজারা দিয়েছিলেন। ওই ব্যবসায়ী গোপনে কালটার ব্যবহার করে প্রচুল আমের ফলন পান। কিন্তু গত বছর তিনি খেয়াল করেন যে কয়েকটি গাছ ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছে। তাই ইজারা বাতিল করে দিয়ে তিনি নিজেই এখন আমবাগানের দায়িত্ব নিয়েছেন। গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ৫০ শতাংশ বাগানে, গোমস্তাপুরে ৩০ শতাংশ, সদরে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং নাচোলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আমগাছে এই কালটার ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তদন্তে শিবগঞ্জ উপজেলার কৃষক আবুল কালাম বলেছেন, এলাকার ৮০ শতাংশ বাগানে রাতে গোপনে কালটার ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আমবাগানে কালটার নামক রাসায়নিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং আমবাগান ধ্বংসের আশঙ্কা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন কৃষি মন্ত্রণালয়ে দেয়। তাতে বলা হয়, বহুবার কীটনাশক ও বালাইনাশক ছিটানোর কারণে আমবাগানে প্রতিবছর নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এখন আমবাগানে অজানা রাসায়নিকের ব্যবহার দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। কালটার তার একটি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কালটার ব্যবহারে প্রথমত গাছের নতুন শাখা-প্রশাখা খাটো হয়ে যায় এবং পাতার আকার ছোট হয়। গাছের আকার-আকৃতি রোগাক্রান্ত অথবা প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি রয়েছে এমন চেহারা হয়। গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। বিভিন্ন রোগ এবং পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। আগাম ফুল আসার প্রবণতা দেখা যায়। ফলের আকৃতি ছোট হয়ে আসে, ওজন কমে যায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকজন কীটনাশক ও রাসায়নিক পণ্যের ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কোম্পানি সিনজেনটার তৈরি একেকটি বোতল ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, ‘কালটার চোরাচালান বন্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে । কৃষকেরা যাতে এটি ব্যবহার না করেন, সে জন্য প্রতিটি আম চাষের জেলায় তাঁদের কাছে প্রচার প্রচারণা চলানো হচ্ছে ।