কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক। দেশের রুই জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে মা মাছের আনাগোনা শুরু হয়েছে। বিপন্ন হালদায় রুই-কাতলার ডিম ছাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন হালদা নদী নিয়ে ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে গবেষণারত নদী ও মৎস্য বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আলী আজাদী। একই সাথে হালদা ও সন্নিহিক নদীগুলোতে প্রজননক্ষম মা মাছ বাড়ানোর উপরও গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি।
ড. আজাদী বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের ফলে উজানের পানি এসে হালদা নদীতে নামে। নদীতে পানির তীব্র স্রোত সৃষ্টি হয়। এর ফলে পানির তাপমাত্রা ২৭-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে ১৪-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিম তা দেয়ার উপযুক্ত হয়। ওই সময় প্রবল স্রোতের কারণে পানি ঘূর্ণনের ফলে ডিম পরিপক্ষ হয়ে ফুটে এবং পোনার জন্য অক্সিজেন প্রাপ্তি বাড়ে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এপ্রিল মাসের ১৪-১৮ তারিখ অথবা ২৭-৩০ তারিখ এবং মে মাসের ১৩-১৭ তারিখ অথবা ২৭-৩১ তারিখ হালদা নদীতে রুই-কাতলা ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময়ে ডিম না ছাড়লে শেষবারের মতো জুন মাসের ১১-১৪ তারিখ ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে বলে তিনি জানান। একই সাথে তিনি এ সময়ে ডিম আহরণকারীদের প্রস্তুত থাকার কথা উল্লেখ করে জানান, উজানে ও ভাটিতে (কেরামতলীর ঘাট থেকে মদুনাঘাটের নিচ পর্যন্ত) দুই গ্র“পে ডিম আহরণকারীরা নৌকা এবং জাল নিয়ে প্রস্তুত থাকলে উজানে বা ভাটিতে যেখানেই ডিম ছাড়–ক তাতে ডিম পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
ড. আজাদী বলেন, মা মাছ দুই ধরনের ডিম ছাড়ে- প্রথমত: নমুনা ডিম এবং পরে পর্যাপ্ত ডিম। আবহাওয়া অনুকূলের ওপর নির্ভর করে প্রথমে অল্প পরিমাণ ডিম ছাড়ে, যাকে স্থানীয় ভাষায় নমুনা ডিম বলে। পূর্ণিমা আমাবশ্যার তিথিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে নদীতে ঢল নেমে স্রোত বাড়লে, পানির তাপমাত্রা কমলে (২৭-২৯ ডিগ্রি সে:) প্রচুর পরিমাণ (লার্জ স্কেল) ডিম ছাড়ে। প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ না হলে মা মাছ ডিম ছাড়ে না।
হালদা নদীতে মা মাছ ও ডিম আহরণ হ্রাসের পেছনে প্রাকৃতিক নানা কারণের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণকে দায়ী করেন তিনি। মানবসৃষ্ট কারণের মধ্যে উজানে ফটিকছড়ির ভুজপুরে কৈয়ারছড়া হালদা নদীর ওপর এবং হালদার উপনদী হারুয়ালছড়ি খালের ওপর নির্মিত দু’টি রাবার ড্যাম এবং হালদার উপনদী ধুরং খালের ওপর নির্মিত ওয়ের ড্যাম দিয়ে শুকনা মওসুমে (ডিসেম্বর থেকে ৩১ মার্চ) উজানে পানি আটকে ধান চাষ দায়ী। পাশাপাশি ১৯৭৪-৭৫ ও ১৯৮২-৮৩ সালে ভাটিতে নদীর প্রজনন এলাকার ১৬টি উপখালে ১৬টি স্লুইস গেট দিয়ে পানি আটকে চাষাবাদ করাও হালদার বিপণ্ন হওয়ার কারণের মধ্যে অন্যতম। এর বাইরে মাদারী খাল, চ্যাং খালি খাল, কাটাখালী খাল, খন্দকিয়া খাল দিয়ে কল-কারখানার বর্জ্য এবং নদীর দুই পাড় থেকে সরাসরি নদীতে এবং নদীর উপখালগুলোতে ব্যাপক হারে পোলট্রির বর্জ্য নিক্ষেপ করা এবং সর্বোপরি অতি-আহরণের ফলে মা মাছের সংখ্যা কমে যাওয়াকে দায়ী করেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রফেসর আজাদীর নেতৃত্বে হালদা ও হালদা সংযুক্ত চারটি নদীর (কর্ণফুলী, সাংগু, চাঁদখালী ও শিকলবাহা চ্যানেল) পানির গুণাগুণ, হাইড্রলজি, মৎস্য এবং মৎস্যসম্পদের ওপর তিন বছরব্যাপী (২০১০-২০১৩) বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণা (স্টাডিজ অন দ্য লিমনোলজি, হাইড্রোলজি, ফিশ অ্যান্ড ফিশারিজ অব দ্য রিভার হালদা অ্যান্ড ইটস ফোর লিংকড রিভারস (সাংগু, চাঁদখালী, শিকলবাহা চ্যানেল অ্যান্ড কর্ণফুলী) পরিচালিত হয়। গবেষণার আলোকে ড. আজাদী বলেন, সব রুই-কাতলা হালদার নিজস্ব আবাসিক মাছ নয়।
হালদা একটি টাইডাল বা জোয়ার ভাটার নদী। হালদার সাথে সংযুক্ত আরো চারটি জোয়ার-ভাটার নদী (সাংগু, চাঁদখালী, শিকলবাহা চ্যানেল অ্যান্ড কর্ণফুলী) রয়েছে। প্রাক-প্রজনন মওসুমে এসব নদী থেকে মাইগ্রেট করে রুই-কাতলা হালদায় ডিম ছাড়তে আসে এবং ডিম দেয়ার পর নিজ নিজ নদীতে ফিরে যায়। সরকারি গেজেট সব কয়টি নদীতে বাস্তবায়ন না হওয়ায় ওইসব নদীতে সারা বছর এবং মাইগ্রেট করে আসা-যাওয়ার পথে বছরের পর বছর নির্বিচারে মাছ ধরার ফলে মা মাছ তথা ব্র“ড ফিশ এখন অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। ড. আজাদী বলেন, নতুন নতুন মানবসৃষ্ট সমস্যাবলী এবং সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন হালদার প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে।
নদীর বাঁকগুলো কেটে দিয়ে ব্র“ড মাছের আবাস নদীর কুম ধ্বংস করা হয়েছে। প্রজনন এলাকায় নদীর খালগুলোর মুখে রয়েছে ১২টি স্লুইস গেট। এগুলো বেশির ভাগ অকার্যকর হয়ে গেছে। এতে করে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে খালগুলো কচুরিপানা আর পলি দিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। যার ফলে মাছের অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর তলায় পলি জমে গভীরতা কমে গেছে, অন্য দিকে মাঝে মধ্যে চর জেগে মাছের মুভমেন্ট বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নদীর গভীরতা বাড়ানো এবং স্রোত সৃষ্টির জন্য অকার্যকর স্লুইস গেটগুলো তুলে দেয়া একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন ভরাট হয়ে যাওয়া হালদার উপনদীগুলো খনন করে আগের গভীরতা ফিরিয়ে আনা। এতে মাছের আবাস পুনঃস্থাপন হবে। অন্য দিকে নানান দূষণে মা মাছের ডিম ছাড়ার পরিবেশকে বিপণ্ন করে তোলা হয়েছে।
দেশের রুই জাতীয় মাছের ডিম সংগ্রহের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হওয়ায় বিভিন্ন সময় নদীটিকে বাঁচাতে নানামুখী সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে; কিন্তু হালদার জন্য বরাদ্দকৃত এই বিপুল অর্থের কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। এমনকি হালদা যাদের জীবিকার উৎস সেই স্থানীয় জেলে এবং জনগণের চাওয়া এবং নানামুখী উদ্যোগেও হালদাকে বাঁচানো যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, প্রাকৃতিক কারণেই হালদায় আবারো বাঁক তৈরি হবে। তিনি এসব বাঁকগুলো রক্ষার পরামর্শও দিয়েছেন। তিনি বলেন, আইন করে লুপ কাটিং (বাঁক) নিষিদ্ধ করতে হবে। হালদার মেজর কার্পের স্টক এসেসমেন্ট ও মাইগ্রেটরি রুট জানা, সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য একান্ত প্রয়োজন। মার্ক অ্যান্ড রিক্যাপার (ট্যাগিং) প্রক্রিয়ায় তা করা যেতে পারে। তিনি অনাগত ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে হালদা স্টক মেজর কার্প লুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষায় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি হালদা ব্র“ড ব্যাংক এবং একটি জিন ব্যাংক অত্যন্ত জরুরি বলে জানান। তিনি হালদার প্রসিদ্ধ স্বল্পজীবি ছোট মাছ (চিরিং, চিংড়ি, কাচকি, বাইলা, পাইস্সা, বাচা) ধরা পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করে বরং নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট এলাকা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পক্ষপাতি।
এতে এসব মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী জেলেদের জীবন রক্ষা পাবে (তাদের সরকার কর্তৃক অতিরিক্ত ভর্তুকি টাকা দিতে হবে না) অন্য দিকে নদীর ইকোলজি ভালো থাকবে এবং স্থানীয় মানুষের প্রোটিন ঘাটতিও পূরণ হবে। ওইসব স্বল্পজীবি মাছ না ধরলে এমনিতেই মাছগুলো নদীতে ২ থেকে ১২ মাসের মধ্যে মারা যায়।
ড. আজাদীর মতে আবাসিক এবং শিল্প বর্জ্য দূষণ থেকে নদীকে বাঁচাতে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া একান্ত জরুরি। ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে বর্জ্য শোধন করার পরামর্শ তার। পোলট্রির বর্জ্য যাতে নদীতে না ফেলে সে জন্য আইন তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া অতি-আহরণের ফলে কমে যাওয়া ব্রুড (মা মাছ) মাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এর পদক্ষেপ হিসেবে হালদাসহ হালদা সংযোগ চারটি নদীতেও হালদার পোনা থেকে তৈরি সাব-এডাল্ট কার্প মাছ প্রতি বছর স্টক করা একান্ত জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
সুত্র, নয়া দিগন্ত / কৃপ্র/এম ইসলাম