কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক।।
কৃষিকাজে ফসল রোপণ ও কর্তনে এখনো কাস্তে-কোদালের মতো সনাতনী হাতিয়ারই ব্যবহার করছেন কৃষক। পুরনো এসব হাতিয়ার চালনার সময় জখম হচ্ছেন কৃষক। অসাবধানতায় কৃষকের হাত বা ত্বকের ক্ষতি হচ্ছে কিংবা শিরা-উপশিরা কেটে যাচ্ছে। কেটে যাচ্ছে হাত ও পায়ের আঙুলের বিভিন্ন অংশও। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, কাস্তে ও কোদাল চালাতে গিয়ে জখম হচ্ছে ৬৭ শতাংশ কৃষক।
দেশের দুটি জেলার মোট ৪৩৪ জন কৃষকের ওপর জরিপ চালিয়ে ‘এগ্রিকালচারাল ফার্ম-রিলেটেড ইনজুরিস ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড কনভেনিয়েন্ট ডিজাইন অব ওয়ার্কার হ্যান্ড টুলস’ শীর্ষক গবেষণাটি করেছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দুই গবেষক মো. সোহেল পারভেজ ও এমএম শাহরিয়ার। জরিপের তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা সহযোগিতা নেন স্থানীয় হাসপাতাল, চিকিৎসক, পল্লী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থার।
গবেষণায় দেখা গেছে, কাজ করতে গিয়ে জখম হওয়া কৃষকের মধ্যে ৬৭ শতাংশই হস্তচালিত প্রথাগত কৃষি হাতিয়ার দ্বারা ক্ষতির শিকার হয়েছে। ভারী আবাদি যন্ত্রে জখম হচ্ছে ২০ শতাংশ কৃষক। জখমের শিকার সিংহভাগ কৃষকের বয়স ১৬-৩০ বছরের মধ্যে। তবে ৫৬ শতাংশ কৃষকের বয়স ৩০ বছরের নিচে। অন্যদিকে ক্ষতির শিকার হওয়া ২৬ শতাংশ কৃষকের বয়স ৩১-৪৫ এবং ১৭ শতাংশ কৃষকের বয়স ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে। ৭৮ শতাংশ কৃষকের জখমের মাত্রা খুব গুরুতর না হলেও ২২ শতাংশ কৃষকের ক্ষেত্রে এ জখম পরবর্তী সময়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষকদের একজন কুয়েটের সহকারী অধ্যাপক মো. সোহেল পারভেজ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, কৃষক পর্যায়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি পৌঁছাতে না পারার কারণে কৃষকরা এখনো নানা ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আবার অনেক সময় হাতিয়ার ব্যবহারে সচেতন না হওয়ার কারণে ছোট ক্ষতিও পরবর্তী সময়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দেখেছি, দীর্ঘক্ষণ কোদাল দিয়ে জমি প্রস্তুতের কারণে এক কৃষকের মাজায় সামান্য ব্যথা হয়েছিল। কিন্তু তখন এ ব্যথার বিষয়ে সচেতন না হওয়ার দরুন এখন তিনি কাজই করতে পারছেন না। আবার অনেক ছোটখাটো ব্যথাও পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের ক্ষতি করছে। তাই এসব হস্তচালিত কৃষিযন্ত্রের পরিবর্তে কৃষককে প্রয়োজনীয় মেশিনারি দিতে হবে। পাশাপাশি চলমান কৃষিযন্ত্রের হাতলের আকার ও ডায়ামিটার পরিমাপ করে কৃষকের কাছে তা পৌঁছে দিতে হবে।
গবেষণাটিতে কৃষকের ক্ষতির মাত্রা নির্ণয়ের পাশাপাশি কতবার ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, সেটিও তুলে আনা হয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৪৩৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক এক বছরে এক বা একাধিকবার জখমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ন্যূনতম একবার জখম হয়েছেন এমন কৃষকের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ। এছাড়া ২৪ শতাংশ কৃষক দুবার, ৭ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষক তিনবার, ২ দশমিক ৮ শতাংশ কৃষক চারবার এবং ৬ দশমিক ৪ শতাংশ কৃষক পাঁচবারের অধিক জখম হয়েছেন।
জখমের ধরনের বিষয়ে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি ঘটে শিরা কেটে যাওয়া এবং হাত ও পায়ের আঙুল কেটে যাওয়ার মতো ঘটনা। প্রায় ২৯ শতাংশ কৃষকের শিরা কেটে যাচ্ছে কাস্তে দ্বারা। অন্যদিকে ২৫ শতাংশ কৃষকের হাত ও পায়ের আঙুল কাটা পড়ছে। অন্যদিকে প্রায় ১৩ শতাংশ কৃষকের পেশিশক্তিতে টান বা ব্যথার কারণ হচ্ছে হস্তচালিত যন্ত্র। অন্যদিকে গভীরভাবে শিরা কেটে যাচ্ছে প্রায় ১১ শতাংশ কৃষকের। এছাড়া প্রায় ৪ শতাংশ কৃষক দীর্ঘমেয়াদে শরীরের যেকোনো একটি অংশ হারাচ্ছে।
এ ধরনের জখম এড়াতে কৃষির সবক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে দি মেটাল প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী সাদিদ জামিল বলেন, কৃষি খাতে জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে শস্য কাটা, মাড়াই, বস্তাবন্দি করা, পরিবহনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়েছে। সেগুলো কৃষকের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছাতে হবে। রিপার, ট্রান্সপ্লান্টার, থ্রেশিং, ডাইং ও সর্টিং মেশিন ছাড়াও কম্বাইন হারভেস্টার কৃষকের পরিশ্রম কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সেগুলো এখনো সারা দেশের সব পর্যায়ের কৃষকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এসব যন্ত্র সংগ্রহ করতে না পারার পেছনে কৃষকের আর্থিক অসঙ্গতি যেমন আছে, তেমনি রয়েছে সচেতনতার অভাব। তাই সরকারি ও বেসরকারিভাবে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
জানা গেছে, শস্য মাড়াইয়ে যন্ত্রের ব্যবহার এখনো মাত্র ১ শতাংশ। এছাড়া ট্রান্সপ্লান্টিংয়ে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ, শস্য শুকানোয় ২ শতাংশ, সর্টিংয়ে ৪ শতাংশ জমিতে যন্ত্রের ব্যবহার হয় এখন পর্যন্ত। তবে আবাদের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ জমিতে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া থ্রেশিং ৭০ এবং উইডিং হচ্ছে ৬৫ শতাংশ জমিতে।
পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলোয় সঠিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে সরকার চেষ্টা করছে বলে জানান কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শ্রমিক সংকট মোকাবেলা ও সামনের দিনে কৃষকের খরচ কমাতে কৃষিযন্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। এরই মধ্যে দেশের জমির আকার ও কৃষকের সামর্থ্য অনুসারে যন্ত্র উদ্ভাবন ও সেগুলোর ব্যবহার বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সিংহভাগ কৃষিযন্ত্রে কৃষক পর্যায়ে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। এসব যন্ত্রে ৩০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি সহায়তা পাচ্ছেন কৃষক। আবার অনেক প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষককে বিনামূল্যে বেশকিছু যন্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার কীভাবে করতে হবে, সেগুলোও কৃষককে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে। যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার বাড়ানো গেলে কৃষকের শারীরিক ক্ষতি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
তথ্য সুত্র, দৈনিক বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম