কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক: কৃষিপণ্যের মুনাফার ৮০ শতাংশই ভোগ করে ফড়িয়া পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা খবর বণিক বার্তা।
কৃষিপণ্যের সরবরাহ চেইনে জড়িত সব পক্ষের মধ্যে কৃষক শ্রম ও সময় দেয় সবচেয়ে বেশি। যদিও এসব পণ্যের মুনাফায় ভাগ সবচেয়ে কম থাকে সে কৃষকেরই।
প্রচলিত উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় মুনাফার সিংহভাগই পকেটস্থ হচ্ছে ফড়িয়া থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীদের।
বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত নানা গবেষণায়ও উঠে এসেছে, ভোক্তাদের হাতে কৃষিপণ্য পৌঁছার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীদারদের (কৃষক থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতা) মোট মুনাফার ২০ শতাংশও কৃষক পান না।
৮০ শতাংশেরও বেশি মুনাফা চলে যায় ফড়িয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেটে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের (এফপিএমইউ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণেও বিষয়টি উঠে আসছে।
‘মনিটরিং রিপোর্ট ২০২১: বাংলাদেশ সেকেন্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান (সিআইপি) নিউট্রিশন সেনসিটিভ ফুড সিস্টেম (সিআইপি২ ২০১৬-২০২০)’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বেগুন, আলু ও টমেটো—এ তিন কৃষিপণ্যের বিপণন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের মূল্য ও মুনাফার বণ্টন দেখানো হয়। এতে দেখা যায়, এসব সবজির উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ায় মোট মুনাফার বণ্টনে কৃষকের প্রাপ্তি সাকল্যে এক-পঞ্চমাংশও নয়।
বাকি মুনাফার পুরোটাই ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগী ট্রেডার বা ফড়িয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
পুষ্টিকর ও সহজলভ্য সবজি হিসেবে ব্যাপক ভোক্তা চাহিদা রয়েছে বেগুনের। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৩২ টাকা দরে বিক্রি হলে তাতে বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের মোট মুনাফা থাকে ১৯ টাকা। এর মধ্যে কৃষকের লাভ থাকে ৩ টাকা ৭২ পয়সা। অর্থাৎ কৃষিপণ্যটির সরবরাহ চেইনের মোট মুনাফায় কৃষকের ভাগ মাত্র ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
গত এক দশকে কৃষিপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন বেড়েছে আলুর। বেগুনের মতো আলুতেও মুনাফার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। কৃষিপণ্যটির বাজারজাতের বিভিন্ন পর্যায়ের মুনাফা যোগ করে যে অংক দাঁড়ায়, তাতে কৃষকের ভাগ ২২ শতাংশেরও কম। টমেটোর ক্ষেত্রে এ হার মোটে ১৩ শতাংশ।
কৃষকরাও বলছেন, ফসলগুলো উৎপাদনে ব্যয়িত সময় ও শ্রম বিনিয়োগের তুলনায় একেবারেই ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা। পরিস্থিতি ভালো থাকলে এসব কৃষিপণ্যে কিছু মুনাফা আসে। কিন্তু কোনো কারণে খারাপের দিকে গেলে তা আর পাওয়া যায় না।
কৃষকের কাছে ভোক্তামূল্যের বিপরীতে সবচেয়ে কম অর্থ আসে টমেটোয়। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি কেজি টমেটো উৎপাদনে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় প্রায় ৮ টাকার কাছাকাছি। তবে তারা কৃষিপণ্যটি বিক্রি করতে পারেন গড়ে সাড়ে ১০ টাকায়। ফলে প্রতি কেজি টমেটোয় কৃষকের মুনাফা থাকে আড়াই টাকার কিছুটা বেশি। তিন থেকে পাঁচ মাস শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগের পর কৃষক যৎসামান্য এ মুনাফা পান।
অন্যদিকে স্বল্প সময়ের মধ্যে এর চেয়ে বেশি পরিমাণে মুনাফা তুলে নিচ্ছেন তিন শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীরা। প্রতি কেজি টমেটোয় ফড়িয়াদের মুনাফা ৩ টাকা ২৫ পয়সা, পাইকারদের ৬ টাকা ৩৫ পয়সা ও খুচরা ব্যবসায়ীদের মুনাফা ৭ টাকা ৫৭ পয়সা।
প্রতি কেজি বেগুন উৎপাদনে কৃষকের গড় খরচ ৯ টাকার বেশি। তবে কৃষক তা বিক্রি করতে পারেন মাত্র ১২ টাকা ৭৫ পয়সায়। যদিও ভোক্তারা পণ্যটি প্রতি কেজি গড়ে ৩২ টাকায় কেনেন।
বিপণন ও সরবরাহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদিত এসব কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করতে অবশ্যই বিভিন্ন পর্যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রয়োজন। তবে এসব ব্যবসায়ী কী মাত্রায় মুনাফা করবেন, সে বিষয়ে কোনো তদারকি বা নিয়ম-নীতি নেই। যে কারণে কৃষক থেকে ভোক্তা এর মধ্যে চার শ্রেণীর ব্যবসায়ীদের মধ্যেই অনৈতিক মুনাফাপ্রবণতা রয়েছে। তাছাড়া যেকোনো পরিস্থিতি এবং সময়ে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এতে উৎপাদক যেমন প্রতারিত হচ্ছেন, তেমনি ঠকছেন দেশের ভোক্তারা।
কভিডকালে সেই প্রবণতা আরো বেড়েছে। অনেক কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, কৃষক একেবারেই কম মূল্যে কিংবা উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে দিয়েছেন তার পণ্য। কিন্তু ভোক্তাকে সেই পণ্য অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কৃষক ও ভোক্তার দামের দূরত্ব আরো বাড়ছে। তাই সঠিক ও কার্যকর নীতিমালার মাধ্যমে এ দূরত্ব কমিয়ে আনার পরিকল্পনা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারি বাজারে বর্তমানে প্রতি কেজি আলু ১৬ টাকা, বেগুন ১০ টাকা ও টমেটো ৮০ টাকা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে খুচরা বাজারে আলু ২৫ টাকা, বেগুন ৩০-৩৫ ও টমেটো ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হলেও এ বাড়তি মূল্যের কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না কৃষকরা। অতিরিক্ত মূল্যের পুরোটাই চলে যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। সে হিসেবে কৃষক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের মুনাফার ব্যবধান এখন আরো বেড়েছে।
কৃষকের মুনাফা বাড়াতে বিভিন্ন সময়ে অর্থসহায়তাসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে এসব পদক্ষেপের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে গিয়েছে। পদক্ষেপগুলোর সুবিধাভোগী নির্বাচন ও সুবিধা বিতরণের প্রক্রিয়াগুলো বারবার অকার্যকর প্রমাণ হলেও তাতে পরিবর্তন আসেনি। ফলে দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা শেষ পর্যন্ত বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে উদ্যোগগুলো কার্যকর হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ সরবরাহ ব্যবস্থায় সবচেয়ে দুর্বল অংশীদার হলেন কৃষক। ফলে তাদের কীভাবে শক্তিশালী করা যায় সে বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইনে আরো দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং কৃষকের মজুদক্ষমতা বাড়ানো ও তথ্য সরবরাহ করতে হবে। আর কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষি উপকরণ ও বিপণন ব্যবস্থা আরো সহজলভ্য করতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদের সাংগঠনিকভাবে দক্ষ করে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, তিনটি কৃষিপণ্যের উৎপাদন গত কয়েক বছরের ব্যবধানে বাড়ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ লাখ ৫৮ হাজার একর জমিতে আলুর উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৯৭ লাখ টন। এবারের মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা থেকে বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে আলু। ফলন ভালো হওয়ার কারণে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াবে উৎপাদন। তবে চাহিদা মন্দায় ২০ লাখ টন আলু নষ্টের শঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে দেশে শীত ও গ্রীষ্ম উভয় সময়েই উৎপাদন হয়ে থাকে বেগুন। প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার একর জমিতে সবজিটির উৎপাদন প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন। অন্যদিকে ৭০ হাজার একর জমিতে টমেটোর উৎপাদন ছাড়িয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৮৮ হাজার টন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করছেন, পণ্য বাজারজাতে পরিবহন সুবিধা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নিশ্চিত করা গেলে মুনাফায় কৃষকের ভাগ বাড়ানো সম্ভব হবে।
বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না, এটা কৃষিতে সর্বকালীন সমস্যা। কভিডের কারণে এ সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। এটি কমাতে হলে কৃষকদের পণ্য বাজারজাতে সরকার পরিবহন সুবিধা দিতে পারে। একই সঙ্গে সময় এসেছে কৃষকদের পণ্য বিক্রিতে ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করার। তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে। কৃষকও ভোক্তার কাছ থেকে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন।
সুত্র: বনিক বার্তা/কৃষি প্রতিক্ষণ/ এম ইসলাম