কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ সরিষা চাষ সরিষা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান তৈল বীজ ফসল। সরিষার তেল শহর গ্রাম সবখানে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের অনেক জমিতে সরিষার চাষ হয়ে থাকে। এই চাষ করা সরিষা থেকে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ টন তেল পাওয়া যায়। আমাদের দেশের গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ভোজ্য তেলের জন্য সরিষার উপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে সরিষার চাষ ও বাজারজাত করা হচ্ছে। সরিষার বীজে গড়ে প্রায় ৪০-৪৪ ভাগ তেল থাকে। সরিষার খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য। এছাড়া মাটির জন্য খৈল খুব উন্নতমানের জৈব সার। সরিষা ভোজ্য তেলের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এর খৈল দিয়ে গবাদি পশুর খাদ্য, মাছের খাদ্য ও জমির জন্য জৈব সার তৈরি করা সম্ভব। আমাদের দেশে ৩ প্রকার সরিষার চাষ হয়। যথা: টরি, শ্বেত ও রাই। এছাড়া বর্তমানে নেপাস সরিষার চাষ উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এর আবাদও হচ্ছে।
সরিষার অন্যান্য জাত ও চাষ সময়সমূহ হচ্ছে :
নাম | হাজার বীজের ওজন (গ্রাম) | বীজে তেলের পরিমাণ (%) | বোনা হতে পাকা পর্যন্ত সময় (দিন) |
টরি | ২.৬-২.৭ | ৩৮-৪১ | ৭০-৮০ |
সোনালি সরিষা (এস এস-৭৫) | ৩.৫-৪.৫ | ৪৪-৪৫ | ৯০-১০০ |
কল্যাণীয়া (টি এস-৭২) | ২.৫-৩.০ | ৪০-৪২ | ৭৫-৮০ |
দৌলত (আর এস-৮১) | ২.০-২.৫ | ৩৯-৪০ | ৯০-১০৫ |
বারি সরিষা-৬ (ধানি) | ৩-৪ | ৪৪-৪৫ | ৯০-১০০ |
বারি সরিষা-৮ (ন্যাপাস-০৯) | ৩.৪-৩.৬ | ৪৩-৪৫ | ৯০-৯৫ |
রাই-৫ | ১.৭-১.৯ | ৩৯-৪০ | ৯০-১০০ |
চাষের উপযোগী পরিবেশ ও মাটিবিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা, বারি সরিষা-৬, রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে।সরিষা চাষের জন্য দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও পলি মাটি উপযুক্ত। সহজে পানি নিষ্কাশন করা যায় এরকম মাটির জমি নির্বাচন করতে হবে।
জমি তৈরি
সরিষার জমি এমন ঝুরঝুরা করে চাষ করতে হবে যাতে সহজেই বীজ থেকে চারা গজাতে পারে।
জমি ৫-৬ বার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে পরিপাটি করতে হবে।
সরিষা জমির বড় বড় ঢেলা ভেঙ্গে সমতল করতে হবে। যাতে জমির কোথাও পানি জমতে না পারে।
জমির চারপাশে নালার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে পরে সেচ দিতে ও পানি নিকাশে সুবিধা হবে।
বীজ বপন
সাধারণত সরিষা বীজ ছিটিয়ে বপন করা হয়। এছাড়া সারিতেও বীজ বপন করা হয়।
ছিটিয়ে বুনলে শেষ চাষে বীজ বপন করে মই দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
সারিতে বীজ বুনলে এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব ৩০ সে. মি. রাখতে হবে।
২-৪ সে.মি. গভীরতায় সরিষার বীজ বপন করতে হবে।
সরিষার বীজ ছোট। তাই বপনের সুবিধার জন্য বীজের সাথে ঝুরঝুরে মাটি অথবা ছাই মিশিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
সারি করে বুনলে জমিতে সার, সেচ ও নিড়ানি দিতে সুবিধা হবে।
বপনের সময় জমিতে বীজের অংকুরোদগমের উপযোগী রস থাকতে হবে। মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকলে ২-৩ দিনের মধ্যে চারা গজাবে।
সার প্রয়োগ
কৃষকদের মতে গুণগত মানসম্পন্ন ভালো ফলন পেতে হলে সরিষা চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে। বাড়িতে গবাদি পশু থাকলে সেখান থেকে গোবর সংগ্রহ করা যাবে। নিজের গবাদি পশু না থাকলে পাড়া-প্রতিবেশি যারা গবাদি পশু পালন করে তাদের কাছ থেকে গোবর সংগ্রহ করা যেতে পারে। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে আবর্জনা পচা সার ব্যবহার করা যেতে পারে। বাড়ির আশে-পাশে গর্ত করে সেখানে আবর্জনা, ঝরা পাতা ইত্যাদি স্তুপ করে রেখে আবর্জনা পচা সার তৈরি করা সম্ভব।
সোনালি সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮ উফশী জাতসমূহে পানি সেচ দিলে ফলন বেশি হয়। বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার আগে) প্রথম সেচ এবং ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে (ফুল ধরার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে। বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে একটি হালকা সেচ দিতে হবে। সরিষা জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই সেচের পানি জমিতে বেশি সময় জমতে দেওয়া যাবে না।
রোগবালাই : জাব পোকা হচ্ছে সরিষার প্রধান ক্ষতিকর পোকা। পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা পোকা উভয়ই সরিষার পাতা, কান্ড, ফুল ও ফল হতে রস শোষণ করে। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ফুল ও ফলের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং পাতা কুঁকড়ে যায়। জাব পোকা এক ধরণের রস নিঃসরণ করে, ফলে তাতে সুটিমোল্ড ছত্রাক জন্মে এবং আক্রান্ত অংশ কালো দেখায়। এজন্য ফল ঠিকমত বাড়তে পারে না; বীজের আকার ছোট হয়। বীজে তেলের পরিমাণ কমে যায়। ফল ধরা অবস্থায় বা তার আগে আক্রমণ হলে এর প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট হওয়ার আশংকা থাকে।
সরিষার পাতা ঝলসানো রোগ : অলটারনারিয়া ব্রাসিসি নামক ছত্রাক দিয়ে সরিষার পাতা ঝলসানো রোগ সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক অবস্থায় সরিষা গাছের নীচে বয়স্ক পাতায় এ রোগের লক্ষণ দেখা যায়। পরে এ ছত্রাকের আক্রমণের গাছের পাতা, কান্ড ও ফলে গোলাকার কালচে দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে পাতা ঝলসে যায়। ফলে সরিষার ফলন খুব কমে যায়।
পরজীবী উদ্ভিদজনিত রোগ : সরিষার পরজীবি উদ্ভিদের মধ্যে অরোবাংকিই প্রধান। সরিষা গাছের শেকড়ের সাথে এ পরজীবী উদ্ভিদ সংযোগ স্থাপন করে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে। এর ফলে পরজীবী আক্রান্ত সরিষার গাছ দুর্বল হয়, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হ্রাস পায়। অরোবাংকি এক প্রকার সপুষ্পক পরজীবী উদ্ভিদ এবং এর বংশ বৃদ্ধি সরিষা গাছের উপর নির্ভরশীল। এর বীজ মাটিতেই অবস্থান করে। মাটি, ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, সেচের পানি প্রভৃতির মাধ্যমে অরোবাংকির উৎপত্তি ও বিস্তার ঘটে। বারবার একই জমিতে সরিষা পরিবারের ফসল চাষ করলে এ পরজীবীর বিস্তার ঘটে।
প্রতিকার: স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে পোকা দমন না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে পরামর্শের জন্য যোগাযোগ করা যেতে পারে।
চাষের সময়ে পরিচর্যা: চারা খুব ঘন হলে পাতলা করে দিতে হবে। পাতলা করার কাজ চারা গজানোর ১০-১৫ দিনের মধ্যে করতে হবে। জমির কোথাও একদম চারা না গজালে প্রয়োজনে সেখানে আবার বীজ বপন করতে হবে। সরিষার জমিতে আগাছা দেখামাত্র নিড়ানি দিয়ে তুলে ফেলতে হবে। বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার ও ফুল আসার সময় দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহ: ক্ষেতের শতকরা ৮০ ভাগ সরিষার ফল যখন খড়ের রঙ ধারণ করে এবং গাছের পাতা হলুদ রঙ ধারণ করে তখন ফসল সংগ্রহ করার উপযুক্ত সময়। সকালে ঠান্ডা আবহাওয়ায় শিশির ভেজা অবস্থায় ফসল সংগ্রহ করা ভালো। মূলসহ গাছ টেনে তুলে অথবা কাঁচি দিয়ে কেটে ফসল সংগ্রহ করা যায়। তবে টেনে তোলাই ভালো।
ফসল মাড়াই ও সংরক্ষণ
ফসল সংগ্রহের পর ৩/৪ দিন রোদে শুকিয়ে মাড়াই করতে হবে।
মাড়াই করার পর বীজগুলোকে ঝেড়ে পরিষ্কার করে ৩/৪ দিন রোদে শুকাতে হবে।
এর মধ্যে কিছু অপুষ্ট বীজ থাকতে পারে। অপুষ্ট বীজগুলো আলাদা করতে হবে।
পরিষ্কার শুকনা পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করলে ১-২ বছর রাখা সম্ভব প্রতি বিঘা জমিতে প্রতিবছর প্রায় ১১০ কেজি সরিষার ফলন হয়ে থাকে।
প্রশ্ন ১ : কি ধরণের মাটি সরিষা চাষের জন্য উপযোগী ?
উত্তর : সরিষা চাষের জন্য দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও পলি মাটি উপযুক্ত। সহজে পানি নিষ্কাশন করা যায় এরকম মাটির জমি নির্বাচন করতে হবে।
প্রশ্ন ২ : কোন সময়ে সরিষার বীজ বপন করতে হয় ?
উত্তর : বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালি সরিষা, বারি সরিষা-৬, রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে।
প্রশ্ন ৩ : সরিষার বীজ কিভাবে বপন করা হয় ?
উত্তর : সরিষার বীজ ছিটিয়ে বপন করা হয়। এছাড়া সারিতেও বীজ বপন করা যায়।
তথ্যসূত্র : কৃষি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল, জুন ২০০৭, Microfinance for Marginal and Small Farmers (MFMSF) Project, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট সেল-১, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ), ঢাকা।