কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ: স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। জমি কমেছে অথচ খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। প্রতিবছর এক শতাংশ হারে ৫০ হাজার হেক্টর আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। অপরদিকে জনসংখ্যা প্রতি বছর ১.৫৪% হারে বাড়ছে। ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য দেশে বিদেশি হাইব্রিড বীজ আমদানি করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এর কারণে পরনির্ভরশীলতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দেশে গড়ে বছরে ১ লাখ টনের মত খাদ্যশস্য ঘাটতি থাকে। হাইব্রিড ফসল ছাড়াও নিচের প্রযুক্তি বা পদ্ধতিতে আমাদের খাদ্য ঘাটতি পূরণ সম্ভব :
জাত উদ্ভাবন : ফলন বেশি দেয়, খরা সহিষ্ণু, লবণাক্ততা সহিষ্ণু, বন্যা সহিষ্ণু, স্বল্প জীবনকাল ও পোকা-মাকড় রোগ প্রতিরোধীজাত উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই কিছু জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
আন্ত:ফসল চাষাবাদ : একই জমিতে একই সাথে একাধিক ফসল চাষাবাদই হচ্ছে আন্তঃফসল চাষ। যেমন তুলা অথবা আখের সাথে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডালজাতীয় শস্য, শাক-সবজি, তেলজাতীয় শস্য, গম ইত্যাদি চাষ করা যায়। ধানের জমিতে মাচা করে শাক-সবজি চাষ করা যায়।
মিশ্র ফসল চাষাবাদ : প্রধান ফসলের সাথে যে কোন একটি শস্য একই জমিতে একই সময়ে উৎপাদন করলে মিশ্র ফসল চাষ হবে। পাটের সাথে ডাঁটা, লালশাক, পুঁইশাক, ডালজাতীয় সবজি চাষ করা যায়। এতে একই জমি থেকে একই সাথে একই খরচে একাধিক ফসল পাওয়া যায়।
রিলে ফসল : কোন ফসল সংগ্রহ করার সাথে সাথে বিনা চাষে ডাল, শাক, ধনিয়া, ইত্যাদি স্বল্পকালীন সময়ে পরবর্তী ফসল চাষ শুরুর আগে চাষ করা যায় । সাধারণত আমন ধান কাটার পর বিনা চাষে ফসলের বীজ বপন করে রিলে ফসল উৎপাদন করা যায়।
রেটুন ফসল : প্রধান ফসল কাটার পর গাছের গোড়া থেকে কুশি গজায়। এই কুশি থেকে বিনাচাষে ও বিনা খরচে ফসল উৎপাদন করা যায়। আখ, কাঁকরোল, কলা ইত্যাদির মুড়ি ফসল উৎপাদন করা যায়।
ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধি : খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়াতে হলে ফসলের নিবিড়তা বাড়াতে হবে। বর্তমানে দেশে ফসলের নিবিড়তা ১৮০%। ২০ বছর আগে ছিল ১৬৬%। ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য যে জমিতে বর্তমানে বছরে একটি ফসল হয় সে জমিতে দু’টি ফসল, যে জমিতে দু’টি সে জমিতে তিনটি এবং যে জমিতে তিনটি ফসল চাষ হয় এমন জমিতে চারটি ফসল উৎপাদন করতে হবে। এ জন্য স্বল্পজীবনকালের ফসলের জাত উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এ ছাড়াও সেচের আওতার জমি বাড়ানো, শস্য বিন্যাস ও শস্য পর্যায় অবলম্বন করা ও জমির উলম্ব ব্যবহার করা।
পতিত জমিতে চাষ : দেশে বর্তমানে ৭.৩ লক্ষ হেক্টর পতিত জমি রয়েছে। এরমধ্যে চাষযোগ্য পতিত জমি আছে ৩.২৩ লাখ হেক্টর। এসব পতিত জমিতে চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ব্যক্তি মালিকানা পতিত জমিতে মালিক চাষাবাদ করতে পারে।
বাড়ির আঙিনায় চাষাবাদ : বসতবাড়ির আশেপাশে অনেক জায়গা পতিত থাকে। এসব জায়গায় শাক-সবজি, ভেষজ, ফুল ও ফল আবাদ করা যায়। এতে বাড়ির মালিক ও দেশ লাভবান হবে। দেশে বর্তমানে ১ কোটি ৭৮ লক্ষ ২৮ হাজার কৃষি পরিবার রয়েছে। বসতভিটা আছে ১ কোটি ১৮ লক্ষ। এসব বসতভিটার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় চাষ করা সম্ভব।
পাহাড়ি এলাকায় চাষাবাদ : দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ এলাকায় পাহাড় রয়েছে। অল্প জায়গায় জুম চাষ ও মশলা চাষ ছাড়া বাকি জমি অনাবাদি থাকে। এখানে সল্ট (SALT – Slopping Agricultural Land Technology) পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ করা যায়। এ পদ্ধতিতে বনজ, ফলদ ও রাবার বৃক্ষের পাশাপাশি শাক-সবজি চাষ, মাছ চাষ, পশুপালন করা সম্ভব।
লবণাক্ত এলাকায় চাষাবাদ : দেশের মোট আবাদি জমির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জমি লবণাক্ত। এসব জমিতে সাধারণত ফসল ভাল হয় না। তবে কিছু লবণাক্ততা সহ্য ক্ষমতাসম্পন্ন বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আরো কিছু জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এ ছাড়াও লবণাক্ততা হ্রাসের পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে।
চর এলাকায় চাষ : বাংলাদেশের নদীর পাড়ের এলাকায় শুধু বালুচর। এসব চরে ফসল বিন্যাস করে বালি মাটির উপযোগী ফসল যেমন, তরমুজ, বাদাম, আখ, সরিষা, ভুট্টা ইত্যাদি ফসল চাষাবাদ করতে হবে।
কৃষি বনায়ন : ফসলের জমিতে, বসতবাড়ির আশেপাশে, পুকুরের পাড়ে, নদী-নালা, খাল-বিলের পাড়ে মাছ, পশুপাখি ও ফসলের সাথে বৃক্ষ চাষাবাদ করা যায়।
উফশীজাতের চাষ : উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল চাষাবাদ করলে খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়বে। দেশে ৫৬টি জাতের ধানসহ সকল ফসলের উফশীজাত উদ্ভাবন করা হয়েছে।
শস্য বহুমুখীকরণ : দেশে ধান ছাড়া প্রায় দু’শতাধিক ফসল চাষাবাদের সুযোগ আছে। সব ধরনের ফসল চাষাবাদ করা উচিত। কারণ এতে ভাতের উপর চাপ কম পড়বে। পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে। মাটির উর্বরতা বাড়বে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়বে।
তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার : কল সেন্টার, রোগ নির্ণয়, পূর্বাভাস জানা, ঋণ ও পণ্য বিতরণ, কৃষি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, তথ্য প্রচার ইত্যাদি কাজ তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে করলে ফসল উৎপাদন সহজ ও বেশি হবে।
প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : দেশে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়। যেমন- লতাপাতা, শাক-সবজির উচ্ছিষ্টাংশ, গাছের শাখাপ্রশাখা ইত্যাদি পচিয়ে জৈব সার তৈরি করা যায়। হাওর-বাঁওড়, পুকুর, ডোবার অব্যবহৃত জলাশয়ে মাছ চাষের ব্যবস্থা করতে হবে।
আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি : নির্দিষ্ট দূরত্বে ফসল বপন/রোপণ করা, সুষম সার ব্যবহার, আগাছা দমন, সমকালীন চাষ, ভাল বীজ ব্যবহার, সেচ নিকাশ ইত্যাদি পদ্ধতিতে চাষ করলে ফলন বাড়ে।
জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগ : আন্তর্জাতিক জৈব প্রযুক্তি সম্মেলনে কৃষি বিজ্ঞানীরা বলেছেন, শুধু জৈব প্রযুক্তি দিয়ে অতিরিক্ত ৩ কোটি মেট্টিকটন খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত এবং প্রচুর চারা উৎপাদন করা যায়। এ ছাড়াও নতুনজাত উদ্ভাবন করে ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
সেচ প্রদান : দেশে মোট আবাদি জমির ৫৮% সেচের আওতায় আছে। বাকি ৪২% সেচের আওতায় আনতে হবে। সেচ দিলে ফলন ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি হয়। যেমন গমে এক সেচ দিলে প্রতি হেক্টরে ২ টন ফলন হয়, তিনটি সেচ দিলে প্রায় ৪ টন ফলন হয়। এ রকম ধান, গোলআলু, শাক-সবজিসহ সব ফসলে সেচ দিলে ফলন বাড়ে।
ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ : হাওর ও জলাবদ্ধ এলাকায় ভাসমান পদ্ধতিতে কচুরিপানার উপর সারা বছর সবজি চাষ করা যায়। ভাসমান পদ্ধতিতে ফসলের চারাও উৎপাদন করা যায়।
অন্যান্য পদ্ধতি :
(১) খরা এলাকায় খরা সহিষ্ণু জাত ব্রিধান-৪৭ চাষ করা যেতে পারে।
(২) চাষযোগ্য সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত স্বাদু পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা।
(৩) জাতীয় কৃষিনীতিতে কৃষিজমি ব্যবহারের আইন বাস্তবায়ন করা।
(৪) যেসব জমিতে সেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতির অভাবে চাষ করা যায় না সে সব জমিতে বিনা চাষে (ডিবলিং পদ্ধতিতে) ফসল উৎপাদন করা।
(৫) বন্যাপ্রবণ এলাকায় আগাম আউশের জাত চাষাবাদ করা (বিআর-২, বিআর-১৪, বিআর-২৬, ব্রিধান-২৭)।
(৬) মঙ্গা এলাকার জন্য ব্রিধান-৩৩ ও বিনাধান-৭ চাষ করা।
(৭) জমির আইলে শাক-সবজি, গো-খাদ্য, ডালজাতীয় শস্য ইত্যাদি চাষ করা। দেশে ১ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমির আইল হিসাবে প্রতিবছর চাষের বাইরে থাকে।
(৮) উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার
(৯) গুটি ইউরিয়া ও এলসিসি ব্যবহার
(১০) প্রচুর পরিমাণে জৈব সার ব্যবহার
(১১) খাল পুনখনন
(১২) প্রিকাস্ট সেচ নালার সম্প্রসারণ
(১৩) কৃষি আবহাওয়া কৃষকদের জানানো
(১৪) লাভ বেশি এমন ফসল চাষাবাদ করা
(১৫) শস্যবীমা চালু
(১৬) বিনাসুদে ঋণ দেয়া
(১৭) ভর্তুকি বৃদ্ধি ও সঠিক প্রয়োগ করা
(১৮) কৃষি ক্লিনিক
(১৯) কৃষি পরামর্শ কেন্দ্র জোরদার করা
(২০) জলবায়ু পরিবর্তন উপযোগী ফসলের জাত ও প্রযুক্তি চিহ্নিত ও উদ্ভাবন করা।
(২১) কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করা
(২২) খাদ্যশস্য প্রক্রিয়াজাত, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ সুষ্ঠু করা।
(২৩) ফসলের পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমনে আইপিএম এর ব্যবহার
(২৪) অর্গানিক খাদ্য উৎপাদনে জোর দেয়া।
(২৫) ঘের পদ্ধতিতে ধান, মাছ, শাক-সবজি ও ফল উৎপাদনে জোর দেয়া।
(২৬) খাদ্যাভাস পরিবর্তন করা।
উক্ত পদ্ধতিগুলো সারাদেশে বাস্তবায়ন করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য খাদ্য নিরাপত্তা বা Food Security একটি প্রকল্প করা যেতে পারে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ, কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, কৃষি সংশিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান। উক্ত পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব শুধু আন্তরিকতা প্রয়োজন।
কৃপ্র/ কে আহমেদ / এম ইসলাম