কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ পৃথিবীর উৎকৃষ্টতম প্রাকৃতিক মৎসাধারের একটি হচ্ছে হালদা। দেশীয় কার্প প্রজাতির মাছ প্রজননের এই প্রাকৃতিক জলাধার প্রকৃত অর্থেই দেশের মৎস সম্পদের এক নির্ভরযোগ্য খনি। এখানেই ডিম দেয় মা মাছ। পরে সেই ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদন করে দেশজুড়ে কার্প জাতীয় মাছের চাষ করা হয়। নানা কারণে সেই হালদা আজ বিপন্ন। হালদা’র এই বিপন্ন দশার পেছনে কারণগুলো খুঁজেছেন কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। মা মাছের ডিম দেয়া দিন দিন কেনো কমছে সে প্রশ্নের উত্তর পেতে সরেজমিনে হালদা পাড়ে ঘুরে স্থানীয় মৎসজীবী, নদী পাড়ের মানুষ এবং বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সেসব কথাগুলোই তুলে ধরেছেন অনলাইনের পাঠকদের সামনে।
হালদা নদী পার্বত্য চট্টগ্রামের বদনাতলি পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে ফটিকছড়ির মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় প্রবেশ করেছে। এটি বয়ে চলছে ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, হাটহাজারি, রাউজান, এবং চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালী থানার মধ্য দিয়ে। এরপর কালুরঘাটের কাছে কর্ণফুলী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে এই নদী। ৮১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদীর ২৯ কিলোমিটার অংশ সারাবছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। প্রতিবছর হালদা নদীতে বর্ষার ঘনবৃষ্টির অমাবস্যার রাতের একটি বিশেষ মূহূর্তে রুই জাতীয় মাতৃমাছ ডিম ছাড়ে। ঘন মেঘের দিনে দুপুরে কিংবা বিকেলেও ডিম ছাড়ে মাছ। ডিম ছাড়ার সেই বিশেষ সময়কে তিথি বলা হয়। স্থানীয় জেলেরা ডিম ছাড়ার তিথির আগেই নদীতে অবস্থান নেন। ডিম দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়েন নদীতে। সংগ্রহ করা ডিম থেকে তারা পোনা তৈরি করেন সনাতনী কায়দায়।
জোয়ার-ভাটার নদী থেকে সরাসরি ডিম আহরণের এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ পোনার জন্য এ নদীর আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকলেও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, বাঁক কাটা, মা-মাছ নিধন, দূষণ, সরকারের উদাসীনতা সহ নানা কারণে এটি এখন বিপর্যয়ের মুখে। প্রতি বছর মা-মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। ১৯৪৫ সালে যেখানে ৪ হাজার কেজি রেণু উৎপাদিত হয়েছিলো, সেখানে চলতি বছর কোন ডিমই সংগ্রহ করতে পারেননি হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা। এবার মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ডিম ছাড়ার প্রতিটি তিথি অপেক্ষা করে তিনবার শুধু নমুনা ডিম পেয়েছেন তারা। তাতে মাত্র ১২ কেজি রেণুু উৎপাদিত হয়েছে। স্মরণকালে হালদার এমন বন্ধাত্ব আর দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পর বছর হালদায় রুই মাছের ডিম ছাড়ার হার কমতে কমতে এই বর্তমান দশা। এবার কারণগুলি সন্ধান করার চেষ্টা করবো আমরা।
হালদা নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয় এটি যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস। কিন্তু হালদা এখন বন্দরনগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের আরেক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দিনের পর দিন হালদার বিপন্ন দশা যেন বেড়েই চলেছে। হালদার নিয়তি এখন রাবারড্যাম, ড্রেজিং, একপাশে জলাবদ্ধতা আরেকপাশে শুষ্কতার অভিশাপে জর্জরিত। চট্টগ্রাম শহরের সব নাগরিক বর্জ্য নালা এসে মিশছে একসময়ের এই মাছের খনিতে। চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে এ নদী থেকে।
হালদা’র কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া জানান,‘ নদীর বাঁকগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাঁকগুলো মাছের জন্য একধরণের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে ডিম দিতে আসা মা মাছেরা আশ্রয় নেয় সেখানে। স্থানীয় জনগণ নিজেদের প্রয়োজনে অপরিকল্পিতভাবে বাঁকগুলো কেটে ফেলার কারণে মা মাছের অভয়াশ্রম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে’। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েকটি প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশে রয়েছে তার মধ্যে হালদা অন্যতম। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাব এবং পরিবেশ দূষণসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে প্রাকৃতিক এই ক্ষেত্র এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।
আমরা টানা কয়েক বছর ধরে হালদা নদীর এই বিপর্যয় ও পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এ নিয়ে একাধিকবার প্রতিবেদনও তুলে ধরেছি। সর্বশেষ কয়েকমাস আগে যখন হালদা নদীর বিপন্ন দশা অনুসন্ধানে কাজ করছি তখন আমাদের সঙ্গে দেখা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থীর। বলা বাহুল্য তারাও হালদার বহুমুখি ক্ষতির গভীরে এখনও প্রবেশ করতে পারেনি। আর হালদা পাড়ের মানুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমনই। একেকজনের কাছে ধরা দিচ্ছে একেক সংকট। হালদা বিশেষজ্ঞ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া অকপটে তুলে ধরছেন হালদার দিনে দিনে ধ্বংসমুখে পতিত হওয়ার আরো কিছু কারণ। মনজুরুল জানান,‘শাখা এবং মূল নদীতে দু’টি রাবারড্যাম হালদার পানি প্রবাহকে বাধাগ্রস্থ করছে। এর ফলে এক দিক সম্পূর্ণ শুষ্ক থাকছে। পরিণামে মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর স্বাচ্ছন্দে চলাচল আর আগের মতো নেই’।
হালদার দূরবস্থা দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনেই মিলল হালদার মাছ নিধনের আরেক চিত্র। যা মাছের প্রজননের অন্যতম এই ক্ষেত্রের জন্য এক ধ্বংসের আয়োজন বলা যায়। নদীতে আড়াআড়ি সুক্ষ্মজাল দিয়ে সবধরণের মাছ ধরছে জেলেরা।এর পাশেই চলছে আরেক অপকর্ম। এটিও হালদা ধ্বংসেরই আরেক প্রক্রিয়া। নদীর কুল ঘেঁষে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে ইটের ভাটা। চলতে চলতে আরেকটি খাল চোখে পড়লো। ওই খাল দিয়েও আসছে নাগরিক বর্জ্য। পাঠক, এভাবেই দিনের পর দিন ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছে হালদা নদী। রুই জাতীয় মাছের এই প্রজনন ক্ষেত্র ইতোমধ্যেই হারিয়েছে তার অধিকাংশ বৈশিষ্ট্য। এখন এই নদীর টিকে থাকাই প্রশ্নের মুখে। চারদিকেই যেন চলছে ধ্বংসের তৎপরতা। অপরিকল্পিতভাবে নদী থেকে বালুও উত্তোলন করা হচ্ছে যান্ত্রিক ড্রেজার দিয়ে।
এদিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার উত্তর মেখন ইউনিয়নের রহল্লাপুরে হালদা সম্প্রসারন সেচ প্রকল্পে নামে আরেকটি ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ চালানো হয়েছে। শুরুতে এটি ৪০ কোটি টাকার প্রকল্প ছিল, এখন প্রকল্পটি পৌছেছে প্রায় চারশ’ কোটি টাকায়। বিশেষজ্ঞদের বিবেচনায় এটিও অপরিকল্পিত একটি প্রকল্প, যা হালদা ধ্বংসেরই আরেক কারণ। এখন পাহাড়ি যে ঢল হালদার পানিতে মেশে তাও নিরাপদ নয়। সেটিও দুষণের আরেক ক্ষেত্র। এখন পাহাড়ে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তামাক চাষ। পাহাড়ি ঢলের পানি মিশছে ক্ষেতের অবশিষ্ট তামাকের সঙ্গে। তার মানে হালদার পানিও এখন তামাকের বিষে দূূষিত।
হালদার এই বহুমুখি ক্ষতি নিয়ে সমন্বিত কোনো জরীপ ও উদ্যোগ আজও পর্যন্ত নেয়া হয়নি। এ পর্যন্ত যা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই খন্ডিত ও আংশিক। যেমন বর্তমান সময়ে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি বুশপুর রাবারড্যাম স্থাপনে হালদার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিরূপনে একটি জরীপ সম্পন্ন হয়েছে। ওই জরীপ সমন্বয় ও তদারকি করছেন বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। তার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত জানান,‘ রাবারড্যামের উচ্চতা মেপে দেখা উচিৎ। দেখতে হবে এই রাবারড্যাম দিয়ে পানি ঠিকমতো প্রবাহিত হচ্ছে কি না। যদি হয়ও ,তবে দেখতে হবে কতটুকু হচ্ছে।’এ কথা জানানোর পাশাপাশি নতুন বিপদ তামাক চাষ প্রসঙ্গ তুলে ধরে অবিলম্বে হালদাকে জাতীয় ঐতিহ্যেও অংশ এবং সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন ড.নিশাত। এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর বর্জ্য হালদা নদীতে অপসারণ, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে হালদার গতিপথ রুদ্ধ করার মতো তৎপরতায় রীতিমত উদ্বিগ্ন চট্টগ্রাম জেলা নদী রক্ষা কমিটি তথা চেয়ারম্যান তথা জেলা প্রশাসন। এ নিয়ে আমরা কথা বলেছি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে।
তিনি বলেন,‘ হালদা রক্ষায় আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। দূষণ বন্ধে ভ্রাম্যমান আদালত গঠন করা হয়েছে, যা নগরীর আবর্জনা এবং নদী পাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম। তবে নদী রক্ষাকারীদের বিরোধীতার পরও কৃষি অধিদপ্তর হালদায় রাবারড্যাম রাখতে চায়। কিন্তু এতে হালদার বুকে চর জাগছে যা নতুন শঙ্কা হয়ে উঠেছে’। প্রিয় পাঠক, আমাদের যা কিছু আছে গলাবাড়িয়ে বিশ্ববাসীর সামনে বলার মতো, তার মধ্যে অন্যতম এক সম্পদ হচ্ছে এই হালদা নদী। এ নদীর প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য্য পৃথিবীতে বিরল। আমরা আজও হালদার এই ঐশ্বর্য্য হয়তো পুরোপুরি আবিস্কারই করতে পারিনি, তাই মূল্যায়নের বদলে দিনের পর দিন অবমূল্যায়ণ করে চলেছি। যেসব কারণে, হালদা আজ সংকটে পড়েছে, বিপন্ন দশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তার সবগুলি কারণই মানবসৃষ্ট। আমরা চাই, সরকার হালদা নদীকে মানবসৃষ্ট এসব অভিশাপ থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেবে। প্রয়োজনীয় গবেষণা ও উদ্যোগ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আবারো ফিরিয়ে আনবে মাছের প্রজননের উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলো। তা না হলে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই নিঃশেষ হয়ে যাবে আমাদের দেশী রুই জাতীয় মাছের এই প্রাকৃতিক উৎস্য ক্ষেত্র।
সুত্রঃ channelionline.com